police

কিছুই তো হয়নি

গত শতকের আশির দশকের এক বাংলা ছবির একটি বহুলপ্রচারিত উক্তি: মাস্টারমশাই, আপনি কিছু দেখেননি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০২২ ০৫:২৮
Share:

গত শতকের আশির দশকের এক বাংলা ছবির একটি বহুলপ্রচারিত উক্তি: মাস্টারমশাই, আপনি কিছু দেখেননি। সম্প্রতি কলকাতার পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য সেই উক্তিকেও হারিয়ে দিয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। নজরুল মঞ্চে গায়ক কেকে-র অনুষ্ঠানকে ঘিরে যে বিপুল শোরগোল ওঠে, সেই বিষয়ে শুক্রবার সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে শ্রীমান বিনীত গোয়েল যা বলেছেন, তার মূল প্রতিপাদ্য— হইচই করার মতো কিছুই সে-দিন ঘটেনি। ‘ড্রোন’-এ তোলা ছবি আদি ‘তথ্যপ্রমাণ’ সহকারে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভিড় বেশি হলেও অপ্রীতিকর কোনও ঘটনা ঘটেনি, গায়কের নিরাপত্তার হানি হয়নি, দর্শকদেরও কোনও সমস্যা হয়নি, যথেষ্ট পুলিশ মোতায়েন ছিল, তারা যথেষ্ট কাজ করেছে। নগরপালের এ-হেন বচন শোনার পরে নাগরিকরা অবশ্যই নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পেরেছেন, ঘুমিয়ে পড়ার আগে হয়তো বা অবাক হয়ে ভেবেছেন, তা হলে চোখের সামনে তুমুল বিশৃঙ্খলার যে সব দৃশ্য দেখা গেল, চূড়ান্ত অব্যবস্থার যে কাহিনিগুলি শোনা গেল, সে-সবই মায়া? মিথ্যে ভেলকি ভূতের হাঁচি?

Advertisement

হ্যাঁ-কে না করে দেওয়ার এই খেলা অবশ্য নতুন নয়। এ-খেলার প্রতিভায় রাজনীতিক ও প্রশাসকদের জুড়ি নেই। তাঁদের লীলায় ভয়ঙ্কর দুরাচার অনায়াসে সাজানো ঘটনা হয়ে যায়, দুর্বৃত্তকুলের তাণ্ডব পরিণত হয় দুষ্টু ছেলেদের ছোট ছোট নষ্টামিতে, বোমা-গুলি-মুখর রক্তস্নাত ভোটপর্ব সেরে নির্বাচনী অশান্তিতে দেশের মধ্যে এক নম্বর রাজ্যের তকমা অর্জন করে পশ্চিমবঙ্গবাসী রাজ্যেশ্বরদের বাণী শোনেন: বিক্ষিপ্ত কয়েকটি ঘটনা বাদে নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ। গুরুতর অনাচারকে লঘু করে দেখানোর এই প্রবণতা কেবল এ-রাজ্যের ধর্ম বলাটাও অন্যায় হবে— অতিমারির কালে চরমতম অন্যায় করে এবং অগণিত মানুষকে অকল্পনীয় দুর্দশায় ফেলে কী ভাবে শীর্ষাসন থেকে অম্লানবদনে ভাবগম্ভীর জ্ঞান বিতরণ করা যায়, সেটাও মহান ভারতের নায়করা দেখিয়ে দিয়েছেন। তবে এ-কথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকরা এই ‘কিছুই হয়নি, সব ঠিকঠাক’ মন্ত্রের সাধনকে একটা শিল্পের পর্যায়ে তুলে দিতে পেরেছেন।

এবং, আশঙ্কা হয়, রাজ্যবাসীও সেই শিল্পের সমঝদার হয়ে উঠেছেন। জনজীবনে সুস্থ স্বাভাবিকতার অভাব দিনে দিনে যত প্রকট হচ্ছে, সে ব্যাপারে জনসমাজের সহনশীলতাও যেন জমাট বেঁধে উঠছে। সাম্প্রতিক কালে এর বড় নজির দেখা গেছে শিক্ষার পরিসরে। এক দিকে স্কুলশিক্ষক নিয়োগে আদিগন্ত দুর্নীতির মামলা, অন্য দিকে অহেতুক স্কুল বন্ধ থাকার ফলে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ভয়াবহ ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি— এক কথায় সর্বনাশের চিত্রনাট্য। অথচ তা নিয়ে, ইতস্তত কিছু বিক্ষোভ বাদ দিলে, সমাজের বিশেষ মাথাব্যথার লক্ষণ নেই। এই নীরব নিষ্ক্রিয়তার পিছনে শাসকদের চটিয়ে দেওয়ার ভয় অথবা তাঁদের খুশি রাখার তাগিদ নিশ্চয়ই কিছুটা কাজ করছে। এমন চাটুকারিতার অনুপ্রেরণা অথবা ভয়ের বাতাবরণ অবশ্যই উদ্বেগের। কিন্তু গভীরতর উদ্বেগের কারণ ঘটে, যদি তেমন কোনও ‘প্রয়োজন’ ছাড়াই নাগরিকরা যা চলছে যেমন চলছে সেটাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করে নেন। বস্তুত, কী স্বাভাবিক আর কী স্বাভাবিক নয়, কোনটা সুস্থ সভ্য সমাজে চলতে পারে আর কোনটা পারে না, তার কোনও দেশকাল-নিরপেক্ষ মাপকাঠি হয় না। পশ্চিমবঙ্গে সেই মাপকাঠি অনেক দিনই অধোগামী, অধুনা সেই অধোগতি একেবারে বাধাবন্ধহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ফ্রি ফল’। অচিরেই হয়তো দেখা যাবে, নজরুল মঞ্চের সাম্প্রতিক ঘটনার অনুরূপ কিছু ঘটলে শাসকদের আর কোনও সওয়াল করার দরকারই হচ্ছে না, সমাজস্থ নাগরিকরা নিজেরাই বলছেন— কিছুই তো হয়নি!

Advertisement

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement