বিতর্কিত সেই পুজো।
কেন সংযমকে সভ্যতার আবশ্যিক শর্ত বলা হয়, তা সবচেয়ে ভাল বোঝা যায় অসভ্যতার রকমারি রূপ দেখলে। কদর্য রুচির স্বভাবধর্মই এই যে, তার অনুশীলনকারীদের কদাচারের কোনও মাত্রা থাকে না, যে অসভ্যতা গত কাল অকল্পনীয় ছিল সেটাই আজ বাস্তবে পরিণত হয় এবং আগামী কাল তা গতানুগতিকও হয়ে উঠতে পারে। দুর্গাপূজার মণ্ডপে অসুরের জায়গায় এমন একটি মূর্তি দেখা যাবে, যার চেহারায় গান্ধীজির প্রকট আদল— এমন কথা কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিলেন কি? অথচ, স্বপ্ন নয়, সেই মূর্তিই ঘোর বাস্তব হয়ে উঠল কলকাতার বুকে! নিন্দা-প্রতিবাদের চাপে রাতারাতি কেশ-গুম্ফ সংযোজনে চেহারা পাল্টে দেওয়া হল, সে তো নিতান্তই ইতিহাসের পাদটীকা হিসাবে লেখা থাকবে। যে ইতিহাস এতদ্দ্বারা রচিত হয়ে গেল, সেটি অনপনেয় কলঙ্কের এবং লজ্জার। লজ্জা শহরের, লজ্জা রাজ্যের, লজ্জা যে কোনও সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকের।
কিন্তু এই চরম লজ্জার থেকেও যে বস্তুটি বহুগুণ বেশি গুরুতর হয়ে উঠেছে, তার নাম উদ্বেগ। উদ্বেগের প্রথম কারণ এই যে, দুর্গাপূজাটির আয়োজকরা বিন্দুমাত্র লজ্জিত নন। ক্ষমাপ্রার্থনা বা আত্মসমালোচনা দূরে থাকুক, তাঁরা অসুর-মূর্তিতে ‘গান্ধীকে দেখানো হয়নি’ বলে দায় সেরেই গান্ধীজি সম্পর্কে তাঁদের বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গির কথা সাতকাহন করে বলেছেন এবং সগৌরবে জানিয়েছেন যে, মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীকে তাঁরা শ্রদ্ধার পাত্র বলে মনে করেন না। গান্ধীজির সমালোচনায় বা তাঁর প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণে কোনও অন্যায় নেই— তাঁর সমকাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বহু মানুষ তাঁর বিরোধিতা করেছেন, ভবিষ্যতেও করবেন। কিন্তু বিরোধিতা প্রদর্শনের জন্য তাঁকে অসুর সাজিয়ে দুর্গার ত্রিশূলের ফলায় বিদ্ধ করতে হবে? ‘বিরোধিতা’র এই ভয়াবহ হিংস্র রূপ আকাশ থেকে পড়ল না, একে নিছক প্রতীকী আক্রমণ বলেও তুচ্ছ করার উপায় নেই। প্রায় পঁচাত্তর বছর আগে গান্ধীজি এই হিংসার বলি হয়েছিলেন, তাঁর মর্মান্তিক হত্যা আজও আমাদের সুতীব্র বেদনা দেয়। সেই হিংসা এবং তার ধারক ও বাহকরা আজ কেবল দেশ জুড়ে বিরাজমান নয়, তাদের দাপট ও আস্ফালন রীতিমতো প্রবল, যার পিছনে রাষ্ট্রশক্তির বিপুল ভূমিকা কার্যকর। কলকাতার পুজোটির আয়োজকদের উচ্চারণে সেই দম্ভের প্রতিধ্বনি। উদ্বেগ অনিবার্য নয়?
উদ্বেগের দ্বিতীয় কারণ, যাঁরা এই হিংস্র কুরুচির নজির সৃষ্টি করলেন, তাঁদের কোনও শাস্তি হয়নি। পুলিশ জানিয়েছে, ওই পূজাটির প্রয়োজনীয় অনুমোদন ছিল না। অর্থাৎ, একটি ‘বেআইনি’ পুজোর আয়োজন করে সেখানে সহসা ওই ‘অসুর’-মূর্তি বসানো হয়েছিল। অথচ তার পরেও মার্জনাভিক্ষার বদলে কার্যত আস্ফালন করে আয়োজকরা পার পেয়ে গেলেন। এমনকি শাসক দলের প্রতিনিধিদের মুখেও ‘কলুষতা’ বা ‘করুণা হয়’ গোছের দায়সারা নিন্দার বেশি কিছু শোনা গেল না। মুখ্যমন্ত্রীও এমন হিংসাশ্রয়ী অসভ্যতার প্রতি তোপ দাগলেন না। প্রশ্ন উঠবেই, কোথায় তাঁদের আটকাচ্ছে? এই নীরবতা কি প্রশ্রয়ের নামান্তর হয়ে উঠছে না? তাঁদের আরও এক বার স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, বিদ্বেষের কারবারিরা এই ভাবেই জল মাপে, অঙ্কুরে বিনাশ না করলে তাদের স্পর্ধা দ্রুত বিষবৃক্ষের মতো বিস্তৃত হয়। অঙ্কুর নয়, চারাগাছও নয়, ইতিমধ্যেই বিদ্বেষের রাজনীতি দেশব্যাপী মহীরুহে পরিণত হয়েছে— তাকে সার-জল জোগাচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতা। পশ্চিমবঙ্গেও তার শাখাপ্রশাখা সুদূরপ্রসারিত। সামাজিক এবং প্রশাসনিক, উভয় স্তরেই এই বিপদের মোকাবিলা জরুরি। গান্ধীজিকে দ্বিতীয় বার হত্যা করার ক্ষমতা মহিষাসুরমর্দিনীরও নেই, মানুষের ইতিহাসে তাঁর মর্যাদাও অলঙ্ঘনীয়। বিপদ আমাদেরই।