আমেরিকার প্রাক্তন বিদেশ সচিব হেনরি কিসিঞ্জার আজ শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। সুস্থ থাকলে তিনি নিশ্চয় গভীর আত্মগ্লানি বোধ করতেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানকে একটি গোটা নতুন দেশ হতে দেখে পঞ্চাশ বছর আগে তিনি উপহাস করেছিলেন ‘আ বটমলেস বাস্কেট কেস’ বলে। অথচ আজ, একান্ন বছরের স্বাধীন জীবন পার করে বাংলাদেশ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে বিশ্বপৃথিবীতে একটি বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে বললে অত্যুক্তি হয় না। বাইরের এবং ভিতরের নানা গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট, অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ, সবের মোকাবিলা করে আজ বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে তার যে সাফল্যময় অবস্থান, বহু উন্নয়নশীল দেশকে তা আত্মজিজ্ঞাসার আবর্তে নিক্ষেপ করতে পারে। গত তিন দশকে বিশ্বে সবচেয়ে স্থিতিশীল উন্নয়ন-গতিরেখা ধরে এগিয়েছে যে যে দেশ— বাংলাদেশ তার মধ্যে উঁচু জায়গা নিয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে জিডিপি-র বৃদ্ধির হারের নিরিখে সর্বোচ্চ স্থান দখল করেছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের আঁচ সে দেশের অর্থব্যবস্থায় লেগেছে ঠিকই, কিন্তু বিশ্ব-অর্থনীতির প্রেক্ষিতে তাকে অস্বাভাবিক বলা চলে না। সে দিন কিসিঞ্জার যখন মন্তব্যটি করেছিলেন, প্রত্যক্ষে যা দেখা যাচ্ছিল, তার উপরেই তিনি নির্ভর করেছিলেন, কেননা তখন নবজাত দেশটি দুনিয়ার চাদ, রোয়ান্ডা, বুরুন্ডির মতো দরিদ্রতম দেশের সঙ্গেই একতলে ছিল। এখন মাথাপিছু জাতীয় আয়ের অঙ্কে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। দারিদ্র কমেছে বিপুল হারে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২৬ সালের মধ্যে নিম্নহারের উন্নয়নশীল দেশসমূহের গোত্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দিকে এগোচ্ছে বাংলাদেশ।
এ যদি অর্থনীতির কথা হয়, রাজনীতির দিকটিও কম চমকপ্রদ নয়। আগামী ২০২৪ সালের প্রস্তাবিত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতলে একটানা চতুর্থ বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরল সম্মান লাভ করবেন শেখ হাসিনা। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে দাঁড়িয়ে গৌরবসহকারে বলাই যায় যে, বিশ্বের দীর্ঘতম শাসনকারী মহিলা প্রধানমন্ত্রী হলেন এক বাঙালি কন্যা— শেখ হাসিনা ওয়াজ়েদ। অত্যাশ্চর্য সব বাধা তাঁকে পেরোতে হয়েছে, দশকাধিক কাল ধরে তিনি প্রাণনাশের হুমকির সামনে দাঁড়িয়ে অকুতোভয়ে, অসামান্য দক্ষতায় দেশ শাসন করছেন। তাঁর ‘ভিশন ২০৪১’ ইতিমধ্যেই দেশেবিদেশে যথেষ্ট বাস্তবসম্মত বলে স্বীকৃত। এই ভিশনের প্রধান কথা: বাংলাদেশ তত দিনে একটি ‘উন্নত’ দেশ হবে, এবং দারিদ্রফাঁদ থেকে সে দেশ মুক্ত হবে। শুনতে অতি-উচ্চাশী মনে হলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বের মূল্য বোঝা যায় তাঁর এই স্বপ্নের বিশ্বময় চর্চার গুরুত্ব থেকেই।
চলতি মাসে যদিও ঢাকায় বিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশ বিশ্বময় সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, দু’টি কথা এই প্রসঙ্গে বলা জরুরি। এক, এমন সমাবেশ যে হতে পারছে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পক্ষে তা স্বাস্থ্যকর চিহ্ন। মুক্ত নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক আবহের সুরক্ষাই শেখ হাসিনাকে বিশ্বময় উচ্চতর মর্যাদা এনে দিতে পারে। এবং, দুই, যে পরিমাণ অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য কট্টর ইসলামি শক্তিসমূহ এই বিরোধী জমায়েতের পিছনে সক্রিয়, তা মনে রাখলে বোঝা যায় কেন আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ— এবং ভারত ও তাবৎ দক্ষিণ এশিয়ার পক্ষে অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের জন্য প্রতিবেশী দেশের সমর্থন কতটা গুরুত্বপূর্ণ, প্রধানমন্ত্রী হাসিনার মনোভাবেই তা স্পষ্ট। ভারতের দিক থেকেও গণতন্ত্র-পন্থী এবং উদারপন্থী বাংলাদেশের গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কের দৃঢ়তা ও গভীরতা অতীতের মতোই ভবিষ্যতেও মুক্তধারায় প্রবাহিত হয়ে চলবে— এমন আশাই থাকুক।