আকাশ জুড়ে যখন সিঁদুরে মেঘ, কেবল ঘরপোড়ারাই বিপদটা দেখতে পায়, যাদের ঘর এখনও পোড়েনি কিন্তু পুড়তে চলেছে অচিরেই, তারা হয়তো বিপদচিহ্নটা তত ভাল দেখতেই পায় না। এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতির আকাশ জুড়ে তেমনই এক সঙ্কটের আভাস— অথচ তাই নিয়ে আলাপ-আলোচনা এখনও আশ্চর্য রকমের স্বল্প। সেই সঙ্কটের নাম— ‘ডিলিমিটেশন’, যার অর্থ জনসংখ্যার ভিত্তিতে লোকসভার রাজ্যভিত্তিক আসনের পুনর্বিন্যাস। এই আসন্ন ঘটনাটি যে ভাবে ভারতীয় গণতন্ত্রকে পাল্টে দিতে চলেছে, তার চেহারাটা যতই স্পষ্ট হচ্ছে, আশঙ্কা ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছে। এবং লক্ষণীয়, এই আসন্ন ঘটনাটি নিয়ে উত্তর ভারত, কিংবা আরও নির্দিষ্ট করে বললে, উত্তর ভারতের হিন্দুবলয় বলে খ্যাত যে অঞ্চল, সেখানে হৃষ্টতার হাওয়া যতই জোরদার হচ্ছে— দক্ষিণ ভারত ততটাই বিপন্ন বোধ করছে। জনসংখ্যার নিরিখে লোকসভা ও বিধানসভায় আসন এর ফলে বাড়তে চলেছে। লোকসভায় আসন যে ভাবে বাড়বে, তাতে জনসংখ্যা যে প্রদেশে বেশি, তাদের আসনের সংখ্যা কম-জনসংখ্যাবিশিষ্ট রাজ্যের থেকে বেড়ে যাবে, এবং/ফলত প্রথম গোষ্ঠীর রাজ্যগুলির ক্ষমতা দ্বিতীয় গোষ্ঠীর রাজ্যগুলিকে ছাপিয়ে যাবে— এটাই হবে ডিলিমিটেশনের অবধারিত ফলাফল। সুতরাং তখন আইন পাশের ক্ষেত্রেই হোক, কিংবা যে কোনও সংসদীয় কার্যক্রমেই উত্তর ভারত যা চাইবে, দক্ষিণ ভারতকে তার সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলতে হবে। দক্ষিণ ভারত তুলনামূলক ভাবে অধিক উন্নয়নশীল, এবং সেই উন্নয়ন-মাত্রার অন্যতম সূচক জনসংখ্যার হার-হ্রাস। কিন্তু এই ঘটনায় যেন সেই অতিবাঞ্ছিত অর্জনটির জন্যই সংসদে তাদের ‘শাস্তি’ পেতে হবে। এ কেবল বিপজ্জনক নয়, অন্যায্যও বটে। যে গণতন্ত্র নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রীয় বলে তার যাত্রা শুরু করেছিল তার পক্ষে এ প্রায় আত্মঘাতের শামিল।
স্বাভাবিক ভাবেই দক্ষিণ ভারতীয় রাজনীতি ক্রমশই এ নিয়ে উদ্বিগ্ন, বিচলিত, ক্ষুব্ধ এবং ভীত হয়ে উঠছে। কিন্তু লক্ষণীয়, বিন্ধ্যপর্বতের উত্তর দিকে যে সব প্রদেশ ঠিক উত্তর ভারতের জনবহুল গোবলয়ের অন্তর্গত নয়— যেমন পশ্চিমবঙ্গ— সে সব জায়গায় কিন্তু এখনও এ নিয়ে আলোচনা উল্লেখযোগ্য রকমের কম। বিপদ এখানেই। কেননা ডিলিমিটেশনের ফলে কেবল উত্তর-দক্ষিণের ভেদই বাড়বে না, রাজনীতি মানচিত্রেও খুব বড় একটি পরিবর্তন আসার ঘোর সম্ভাবনা। হিন্দুত্ববলয় বলে উত্তরের যে অঞ্চল খ্যাত, সেখানে যে রাজনীতি জনপ্রিয়, তা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের রাজনীতিকে অনেকাংশে গ্রস্ত করে দিতে চলেছে। সহজ কথায়, বিজেপির এতে বিরাট লাভ। অর্থাৎ কেবল যুক্তরাষ্ট্রীয়তার বিপদই ঘটবে না এর ফলে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির চেহারাও অনেকটা পাল্টাবে।
‘ডিলিমিটেশন’ একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। তবে প্রতি বার জনগণনার পরেই এক ধরনের আসন পুনর্নির্ধারণ ঘটলেও গত পঞ্চাশ বছরে লোকসভা ও বিধানসভার আসনের মোট সংখ্যার কোনও হেরফের হয়নি। যেমন পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা আসন ৪২ ও বিধানসভা আসন ২৯৪ থেকে গিয়েছে। জনসংখ্যার হেরফের অনুযায়ী তাদের চেহারা পাল্টেছে, সংখ্যা নয়। পঞ্চাশ বছর পর এই বার যে-হেতু আসনসংখ্যাই বাড়তে চলেছে, গোলযোগ সেখানেই। প্রসঙ্গত, মহিলা সংরক্ষণ আইনের সঙ্গে এই ডিলিমিটেশন-কে জোড়ার প্রবল প্রয়াসের একটি কারণই হল মোট আসনসংখ্যার বৃদ্ধি, যার ফলে পুরুষ আসন শেষ অবধি খুব বেশি কমবে না ধরে নিয়েই পুরুষতান্ত্রিক হিন্দুত্ববলয়ের নেতা-কর্তাদের বিষয়টিতে রাজি করানোর চেষ্টা চলছে। সব মিলিয়ে, বললে ভুল হবে না যে, ডিলিমিটেশন-ই হতে চলেছে শাসক বিজেপির সেরা তুরুপের তাস, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জবরদস্ত কৌশল। ভারতের গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রের চরিত্র পরিবর্তনের রাস্তাটি ক্রমশ পাকা হচ্ছে।