প্রতীকী ছবি।
নীরবতা কেবল বাঙ্ময় নহে, কর্ণবিদারীও হইতে পারে। যেমন পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির সাম্প্রতিক একটি ভয়ঙ্কর উক্তি সম্পর্কে সিপিআইএমের নীরবতা শুভবোধসম্পন্ন নাগরিকের নিকট সেই অর্থে বিদারণকারী। ঠিকই, আব্বাস সিদ্দিকি তো কেবল ধর্মগুরু হিসাবে পরিচিত নহেন, ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা, গত নির্বাচনে বামফ্রন্ট তথা সিপিআইএমের নেতারা তাঁহার সহিত অসীম আস্থায় হাত মিলাইয়াছিলেন। সেই কাহিনিকে হয়তো আলিমুদ্দিনের কর্তারা এখন ইতিহাস বলিয়া শিকায় তুলিবার চেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু সেই ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণের নিকট তাঁহাদের একটি রাজনৈতিক দায় থাকিয়া যায়। ব্রিগেডের ময়দানে আয়োজিত নির্বাচনী জনসভায় এই নবীন সঙ্গীর আবির্ভাব এবং তাঁহাকে লইয়া সিপিআইএম নেতাদের উৎসাহ উদ্দীপনার ছবি বাংলার নাগরিকের চিত্তপট হইতে মুছিয়া যায় নাই। তাহা তখন জরুরি ছিল কি না, কৌশলপ্রণোদিত ছিল কি না, সেই সব তর্কের হয়তো পুনরবতারণার দরকার নাই। তবে রাজনীতির বাহিরে, রাজনীতির ঊর্ধ্বে যে নৈতিকতার দাবিটি থাকে, অন্যায়ের প্রতিবাদ সেই নৈতিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। সঙ্গী পুরাতন হইলেও সে প্রবল অন্যায় আচরণ করিলে তাহার নিন্দা এবং প্রতিবাদ না-করাটি কেবল অনৈতিক কাজ নহে, নীতিগত ভাবে গর্হিত হইয়া দাঁড়াইতে পারে।
বাস্তবিক, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক গোলযোগ উপলক্ষে আব্বাস সিদ্দিকি প্রকাশ্য সমাবেশে যাহা বলিয়াছেন, তাহা কেবল হিংসাত্মক নহে, অত্যন্ত বিপজ্জনক। এমন একটি কুৎসিত উক্তির কথা জানিবার সঙ্গে সঙ্গে কঠোর ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাহার নিন্দা করা পশ্চিমবঙ্গের সকল অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের কর্তব্য। আইএসএফ দলটিরও— যদি না তাহারা এই নেতার মতের সহিত গলা মিলাইতে চাহে। কিন্তু সপ্তাহ পার হইয়া গিয়াছে, নীরবতা ক্রমশই যেন গভীরতর হইতেছে। যাঁহারা বলিতেছেন যে, আব্বাস সিদ্দিকি যেখানে কথাগুলি বলিয়াছেন, তাহা রাজনৈতিক সভা নহে, ধর্মীয় সমাবেশ, আইএসএফ দল হিসাবে এমন কোনও অন্যায় উক্তি করে নাই, বরং বাংলাদেশ বিষয়ে যথাযথ প্রতিক্রিয়াই জানাইয়াছে— তাঁহারা যুক্তির বদলে অজুহাত দিতেছেন। যাহা শোনা যায়, দেখা যায়, তাহাই রাজনীতি। সমর্থন যদি শোনাইবার ও দেখাইবার যোগ্য হয়, নিন্দাও শোনাইবার ও দেখাইবার বস্তু।
কেন এই নীরবতার রাজনীতি ক্ষতিকর এবং উদ্বেগজনক, বুঝিতে অসুবিধা হয় না। সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, সেই রাজনীতির কারবারিরা অতিমাত্রায় সক্রিয় হইয়াছেন। বাংলাদেশের ঘটনা লইয়াও সেই সক্রিয়তা ইতিমধ্যেই প্রকট। আব্বাস সিদ্দিকির মন্তব্যটিকে এই পরিপ্রেক্ষিতেই গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল। সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী রাজনীতির অনুশীলনকারী হিসাবে যে যে দল নিজেদের জাহির করে, তাহারা এই গোড়ার কথাটি না বুঝিলে চলিবে না। আজ যদি উগ্র সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ্য আস্ফালনের বিরুদ্ধে সরব না হওয়া যায়, ক্ষুদ্র রাজনীতির মুখ চাহিয়া অন্য দিকে তাকাইয়া থাকা হয়, পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে তাহা বিষম অশুভ হইতে পারে। অজয় ভবন হইতে আলিমুদ্দিন অবধি ঐতিহাসিক ভুলের অগণন স্মারক রচিত হইয়াছে, বিপজ্জনক ভুল আর না বাড়াইলেই নয়?