Corruption and Politics

চক্রবৎ

যে সমাজ যত বেশি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, তার দুর্নীতি-প্রবণতা আরও বেশি করে বাড়তে থাকে বলে বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ মে ২০২৪ ০৭:৫৮
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

গণতন্ত্রের দেশে ভোট এমন একটি উৎসব যে সময় গোটা সমাজের নিজেকে নিয়ে নতুন ভাবে ভাবার কথা। তবে ভাবার কথা বলেই ভাবা হয়, এমনটা বলা চলে না। সাম্প্রতিক কালে ভোটঋতু হয়ে দাঁড়িয়েছে, একে অপরের প্রতি অভিযোগ প্রক্ষেপণ। সমাজ-অর্থনীতির মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা সেখানে কম, নিতান্ত নগণ্য। এই অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতাটি কেন, কত দিন ধরে তা শুরু হয়েছে, কী ভাবে এত দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে, এ সব নিয়ে সামাজিক আত্মসমীক্ষণ ও বিশ্লেষণ জরুরি। তবে এই প্রসঙ্গে একটি বিষয়ের কথা আলাদা ভাবে বলতে হয়— যার নাম দুর্নীতি। প্রতিটি রাজনৈতিক দলই পরস্পরের দিকে দুর্নীতির অভিযোগ চালনা করে যায়, চলে উত্তর-প্রত্যুত্তরের পালা, পাল্টা কাদা ছোড়াছুড়ি, আর ‘হোয়াটঅ্যাবাউটারি’ বা আগে কী হয়েছিল। মনে হতে পারে, ভারতের ভোটার এখন একমাত্র এই বিষয়েই যেন আগ্রহী: দুর্নীতি, বিশেষত রাজনৈতিক দুর্নীতি, যা সাধারণ মানুষের জীবনপ্রাণ ওষ্ঠাগত করে ফেলেছে। পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরা যাক। স্কুল সার্ভিস কমিশনের মামলা এবং সন্দেশখালির দৃষ্টান্ত একাধারে রাজ্য সরকারকে কোণঠাসা করতে ব্যস্ত— দু’টিই দুর্নীতির গভীর ও ব্যাপ্ত হিমশৈলের চূড়া। গত কয়েক বছরে তোলাবাজি, সিন্ডিকেট, নারদা, সারদা, গরু পাচার, কয়লা পাচার, রেশন— বহু ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর দুর্নীতির উপর্যুপরি প্রমাণে রাজ্যবাসী বিধ্বস্ত ও অবসন্ন। তবে, সন্দেহ হয়, নাগরিক সমাজে অন্য একটি ধারণাও বিশেষ গভীর, সেটা হল, যে যায় প্রশাসনে সেই হয় রাবণ। এই বোধটি ইতিহাসনির্ভর, অবশ্যই, তবে ভবিষ্যৎ বিষয়েও তা এক পরিব্যাপ্ত ধ্বস্তবোধ ও অবসাদ তৈরি করে চলেছে।

Advertisement

বৃহত্তর সমাজের এই হতাশার একটি প্রত্যক্ষ কারণ, দুর্নীতি বিষয়টি আসলে স্বশক্তিবৃদ্ধিকারী (সেলফ-রিইনফোর্সিং)। যে সমাজ যত বেশি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, তার দুর্নীতি-প্রবণতা আরও বেশি করে বাড়তে থাকে বলে বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছেন। এর পিছনে রাজনৈতিক দলের নাম-পরিচিতি কতখানি গুরুতর, তা খানিক সন্দেহ-উদ্রেককারী, কেননা সাধারণ বিভিন্ন দলেই নেতাদের চার পাশে যারা প্রধান ক্রিয়াশীল, তারা দুর্নীতি-চক্রের (নেটওয়ার্ক) সঙ্গে যুক্ত, এবং প্রয়োজনে রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে সেই ‘চক্র’পরিচয়েই তারা বেশি আগ্রহী। রাজনৈতিক দল ও সরকারের সঙ্গে এদের সম্পর্ক খানিকটা ‘এনেবলার’ বা সক্রিয় প্রশ্রয়দাতার উপর নির্ভরতার মতো। যখন সেই সক্রিয়তা কোনও কারণে বিনষ্ট, তখন প্রশ্রয়ও শেষ, এবং সংযোগও ক্ষীয়মাণ। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে, রাজনীতি দুর্নীতিকে চালায়, না কি দুর্নীতি রাজনীতিকে চালায়— এই প্রশ্নটি ‘মুরগি আগে না ডিম আগে’র মতোই ধাঁধা হয়ে উঠতে পারে।

রাজনীতি এবং দুর্নীতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এতখানি সম্পৃক্ত বলেই ভোটদাতার মানসভুবনে তার প্রভাব কেমন ও কতখানি, এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ তৈরি হয়। প্রসঙ্গত, আজ থেকে দশ বছর আগে সিএসডিএস-কৃত একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, তৎকালীন ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত টুজি কেলেঙ্কারি বিষয়ে মানুষের আগ্রহ অত্যন্ত কম, এবং আগ্রহীদের মধ্যেও অভিযুক্ত শাসকের প্রতি রাগ বা বিরাগ আরও কম। ভাবলে ভুল হবে যে, ভারতীয় নাগরিক দুর্নীতিকে পাত্তা দেন না। আসল কথা, ভোটাররা যে ভাবে ভাবেন, এবং রাজনৈতিক দলগুলি প্রচারের স্বার্থে তাকে যে ভাবে তুলে ধরে, তার মধ্যে একটা বড় ফারাক ঘটে যায়। সম্ভবত প্রাত্যহিক দিনযাপনে যদি রাজনৈতিক দুর্নীতির প্রভাব পড়ে, এবং শাসক দলের তুলনায় অপরাপর দল বিষয়ে সাধারণ ধারণা যদি অনেকখানি আলাদা হয়, তবেই তার একটি ফল ভোটের মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। ‘না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা’ নিশ্চয় স্লোগান হিসাবে চিত্তাকর্ষক, কিন্তু দ্বিতীয়াংশের সঙ্গে প্রথমাংশও বিশ্বাসযোগ্য হলে তবেই তা কার্যকর হয়ে উঠতে পারে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement