সমাজমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে জানালেন মুখ্যমন্ত্রী যে, তাঁর বক্তব্যের ‘অপব্যাখ্যা’ করা হচ্ছে। তিনি আন্দোলনরত ডাক্তারদের কিছুই বলেননি— যা বলেছেন, সবই বিজেপির উদ্দেশে, যারা কেন্দ্রীয় সরকারের মদতে এ রাজ্যের গণতন্ত্রের ক্ষতি করে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায়। ‘ফোঁস’ করার কথাও শুধু শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের উদ্ধৃতিমাত্র। মুখ্যমন্ত্রী বলছেন যখন, তাঁর কথা বিশ্বাস না করে উপায় নেই। তবে, যে কথা বলার পর দিনই তার তেরো হাত ব্যাখ্যা দিতে হয়, সে কথা বলার আদৌ কোনও প্রয়োজন ছিল কি না, মুখ্যমন্ত্রী ভেবে দেখতে পারেন। কথা বন্দুকের গুলির মতোই— এক বার বেরিয়ে গেলে তাকে আর ফিরিয়ে আনার উপায় থাকে না। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভায় তিনি যে ‘ফোঁস’ করার পরামর্শ দিলেন, ‘বদলা নয়’-এর মন্ত্র বিস্মৃত হওয়ার কথা বললেন, সেই কথাগুলিকে যদি কোনও ‘তাজা ছেলে’ আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে? ১৪ অগস্ট রাত্রে যারা আর জি কর হাসপাতালে চড়াও হয়েছিল, তারা যদি ফের ডাক্তারদের একটু সমঝিয়ে দিতে চায়? মুখ্যমন্ত্রীর মনে যে তিলমাত্র অসূয়া নেই, সে কথা তো সকলে না-ও বুঝতে পারে— তাঁর মুখের কথাকেই মনের কথা ভেবে নিতে পারে। অতএব, কথাগুলি বলার আগে একটু ভেবে নিলে মন্দ হত না। বাক্সংযম বস্তুটি অবশ্য পরিস্থিতি ও ব্যক্তিনির্বিশেষেই অনুশীলন করা ভাল। তাতে ভুল-বোঝাবুঝির সম্ভাবনা কমে, পরে ব্যাখ্যা দেওয়ার ঝক্কিও থাকে না।
অস্বীকার করা চলে না, রাজ্যের হাসপাতালগুলিতে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তা যে কোনও প্রশাসকেরই রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে বাধ্য। বাইরে প্রাত্যহিক আন্দোলন, মিটিং-মিছিল, এবং হাসপাতালের পরিসরে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি ইত্যাদিতে সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। এমনিতেও ধৈর্যশীল হিসাবে তাঁর খ্যাতি তেমন বিপুল নয়, কখনও ছিল না— আজকের এই অস্থিরতায় সেটুকুও অবশিষ্ট নেই বলেই অনুমান করা চলে। কিন্তু, ব্যক্তির যে ধৈর্যহীনতার অধিকার আছে, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের তা নেই। তাঁর প্রতিটি কথা, এবং প্রতিটি নীরবতা তাৎপর্যপূর্ণ, এবং রাজ্যবাসীর অধিকার আছে তাঁর সেই কথা ও নীরবতার ব্যাখ্যা করার। কাজেই, দায়িত্বটি তাঁর। যে ভঙ্গিতে তিনি জুনিয়র চিকিৎসকদের কাজে ফেরার সুপরামর্শ দিয়েছেন, কারও কানে তাতে হুমকির অনতিপ্রচ্ছন্ন সুর বাজলে শ্রোতাকে দোষ দেওয়ার পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রীরই ভাবা উচিত, উচ্চারণে কোথাও ভুল ছিল কি না। আজ কোনও কথা বলে কাল তার ব্যাখ্যা দেওয়া, এবং কদর্থ করা হচ্ছে বলে অন্যের দিকে আঙুল তোলার চেয়ে অনেক সহজ কাজ, আজই কথাটা বলার আগে ভেবে নেওয়া যে, সত্যিই তিনি সে কথা বলতে চান কি না।
ঘটনা হল, যে কথাগুলি মুখ্যমন্ত্রীর বলা উচিত ছিল, যে কথাগুলি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের কাছে প্রত্যাশিত ছিল, তার অনেকগুলিই তিনি গত তিন সপ্তাহে বলে উঠতে পারেননি। রাজ্যের সর্বময় কর্ত্রী হিসাবে তাঁর দায়িত্ব ছিল নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করার— নিহত চিকিৎসকের পরিবারের কাছে, রাজ্যের চিকিৎসক সমাজের কাছে, রাজ্যের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে। যে বিপুল প্রশাসনিক ব্যর্থতায় শেষ অবধি এমন ভয়ঙ্কর ও মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে, তার দায় রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানকে নিতেই হবে— রাজ্যের সমস্ত কৃতিত্বেই যখন তাঁর একচ্ছত্র অধিকার, ব্যর্থতার দায়ও তাঁরই। মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য ছিল, এই ঘটনাটিকে সঙ্কীর্ণ রাজনীতির বাইরে রাখা— বিরোধী দলগুলি প্রশ্নটিকে দলীয় রাজনীতির পাঁকে টেনে নিয়ে যেতে চাইলেও রাজ্যের প্রধান হিসাবে তার ঊর্ধ্বে থাকা উচিত ছিল। মুখ্যমন্ত্রী সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হেঁটেছেন। তাঁর উচিত ছিল মানুষকে আশ্বস্ত করা যে, এমন ঘটনা আর কখনও ঘটবে না, পশ্চিমবঙ্গের কোনও প্রান্তে নয়— সেই আশ্বাসও তাঁর কাছে পাওয়া যায়নি। এমন ক্রান্তিকালেও তিনি রাজনীতির পরিধিকে অতিক্রম করতে পারলেন না, এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী?