ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪(ক) ধারাটির বিষয়ে আমার মত হল, এটি অত্যন্ত আপত্তিকর এবং বিচিত্র একটি আইন; স্বাধীন দেশের জন্য আমরা যে আইন তৈরি করছি, তাতে ব্যবহারিক এবং ঐতিহাসিক, দুই কারণেই এই আইনটির কোনও স্থান হওয়া উচিত নয়। যত দ্রুত আইনটিকে বিদায় করা যায়, ততই ভাল।”— বক্তার নাম জওহরলাল নেহরু। কিন্তু আইনটি যে তিনি বিদায় করতে পারেননি, ভারতের বর্তমান সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা সুপ্রিম কোর্টে তা মনে করিয়ে দিয়ে বললেন, নেহরু যা পারেননি, তাঁরা সেটাই করার চেষ্টা করছেন। সেই চেষ্টার স্বরূপ কী, সেই বিতর্কে না ঢুকে বরং এক বার ফিরে দেখা যায় ৭১ বছর আগের সেই মুহূর্তটিকে, যখন দেশের প্রথম সংবিধান সংশোধনী উপলক্ষে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন সম্বন্ধে কথাটি বলেছিলেন নেহরু। সংবিধানের ধারা ১৯-এর অন্তর্গত বাক্স্বাধীনতার উপধারাটিতে জোড়া হয়েছিল কয়েকটি শব্দ— বলা হয়েছিল, বৈদেশিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক নষ্ট হতে পারে, দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হতে পারে, অথবা অপরাধমূলক কাজকর্মে উস্কানি দিতে পারে, এমন কোনও কথাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার্থে ছাড় দেওয়া যাবে না। সংসদের কক্ষে এই সংশোধনীর প্রস্তাবটি পেশ করেছিলেন স্বয়ং নেহরু। বৃহত্তর প্রশ্নটি, অতএব, এই রকম— রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা বৈদেশিক সম্পর্কের নামে ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করার সিদ্ধান্তটি ‘উদারবাদী’ নেহরু কী ভাবে নিলেন, কী ভাবেই বা তার পক্ষে যুক্তি খাড়া করলেন?
ইতিহাসের কোনও মুহূর্তকে ফিরে প্রশ্ন করলে তার তিনটি উপাদানের দিকে নজর দেওয়া বিধেয়— স্থান, কাল ও পাত্র। প্রথমে পাত্রের কথাই বলা যাক। সংসদে দাঁড়িয়ে নেহরু মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, এই সংশোধনীটি সংসদে পেশ করার পূর্বে বহু বার বিভিন্ন পরিসরে আলোচিত হয়েছে। তবুও এই সংশোধনীর পিছনে তাঁর ভূমিকার কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কেন এমন সংশোধনী প্রয়োজন, সে কথা বলতে গিয়ে তিনি অন্তত দু’বার আমেরিকার সংবিধান ও আদালতের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন। বলেছিলেন, সে দেশে সংবিধানের অক্ষর অলঙ্ঘ্য, তবুও দীর্ঘ চর্চার ফলে আদালতের প্রজ্ঞা সেই সংবিধানের অক্ষরের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুসারে বিচার করতে পারে। ভারতেও তেমন ঘটনাই ঘটবে, আশা প্রকাশ করেছিলেন নেহরু— কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে অন্তত এক বা দুই প্রজন্ম। তত দিন অবধি যে-হেতু অক্ষর দ্বারাই পরিচালিত হবে বিচার, ফলে তা যেন সংবিধানের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে— অর্থাৎ দেশের সামগ্রিক উন্নতি— ব্যাহত না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। নেহরুর রাষ্ট্রকল্পনাটি ছিল চরিত্রগত ভাবে অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদী— তাঁর বিশ্বাস ছিল, অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটলে, এবং সেই উন্নতির সুফল সর্বজনীন হলে অন্য সমস্যাগুলি আপনা থেকেই মিলিয়ে যাবে। যত ক্ষণ না তা ঘটে, তত ক্ষণ অবধি কাজ চালানোর মতো ব্যবস্থা প্রয়োজন— এমন ব্যবস্থা, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূত্রে গ্রন্থিত জাতীয়তাবাদের ধারণাটিকে অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবে, তাতে কোনও বাধা আসতে দেবে না।
এখানে স্থান ও কালের ভাবনাও জরুরি। দেশ সদ্য স্বাধীন। তাকে ঘিরে সমানেই কাজ করে চলেছে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি। ভারত নামক গ্রহণশীল, উদার ধারণাটির প্রতিস্পর্ধী অবস্থান গ্রহণই শুধু নয়, বারে বারেই দাবি উঠছিল মুসলমানদের শায়েস্তা করার। তৎকালীন আইনমন্ত্রী ভীমরাও রামজি আম্বেডকর প্রথম সংশোধনীর পক্ষে দাঁড়িয়ে সংসদে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট, এবং পঞ্জাব, মাদ্রাজ ও পটনা হাই কোর্টের একাধিক রায়ের কথা— যে রায়গুলি মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে কার্যত হিংস্রতার প্রচারকে অবাধ করে দিয়েছিল। পটনা হাই কোর্টের বিচারপতি সরজূ প্রসাদের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য— একটি মামলায় রায় দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ভারতের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবাধে মানুষ খুন করার কথা বলার, অথবা তাতে ইন্ধন জোগানোরও অধিকার দেয়! সংবিধানের এই ব্যাখ্যা যে তার আদর্শের সমানুবর্তী নয়, সে কথা তর্কাতীত। নেহরু বা আম্বেডকর যখন তাঁদের সহকর্মীদের সঙ্গে বাক্স্বাধীনতার সীমা নির্ধারণ করার পথ খুঁজছিলেন, সেই মুহূর্তে তাঁরা বিরোধী দমন করার নয়, সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার পথই হয়তো খুঁজছিলেন। সেই সন্ধানের পথরেখা বেয়ে পঁচাত্তর বছরে স্বাধীন দেশ কোথায় পৌঁছল, সেটাই আজকের বিবেচ্য।