একশত দিনের কাজ প্রকল্পের অধীনে কর্মসংস্থান আরও বাড়াইতে পরামর্শ দিয়াছে নীতি আয়োগ। গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখিবার জন্যই এই পরামর্শ। তাহাতে যে খুব নূতনত্ব আছে, তেমন দাবি করিবার উপায় নাই। ‘মহাত্মা গাঁধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা আইন’ যে কোনও আবেদনকারীকে অন্তত একশত দিন কাজ জুগাইবার যে প্রতিশ্রুতি জুগাইয়াছে, তাহাকেই সম্বল করিয়া সরকার সকল দুর্যোগের মোকাবিলা করিয়া আসিতেছে। গত বৎসর করোনা সংক্রমণ অতিমারি রূপ ধরিবার পর কর্মহীনতা এবং অনাহার এক দ্বিতীয় অতিমারি হইয়া দেখা দিয়াছিল। তাহার মোকাবিলায় মানুষের হাতে নগদ অনুদান দিবার পরামর্শ দিয়াছিলেন কিছু অর্থনীতিবিদ। সরকার তাহা মানে নাই— কর্মহীন মানুষের হাতে নগদ টাকা পৌঁছাইবার জন্য একটিই কার্যসূচি গ্রহণ করিয়াছিল, তাহা একশত দিনের কাজের প্রকল্প। সরকারি নথি অনুসারে, ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে এগারো কোটি ব্যক্তি কাজ পাইয়াছেন, তাঁহাদের পারিশ্রমিক স্বরূপ কেন্দ্রীয় সরকার দিয়াছে আটাত্তর হাজার কোটি টাকা। এই প্রকল্পের পনেরো বৎসরের ইতিহাসে যাহা অভূতপূর্ব। ইহা আশ্চর্য নহে— ভারতে অন্তত দুই কোটি পরিযায়ী শ্রমিক কাজ হারাইয়া, সর্বস্বান্ত হইয়া গ্রামে ফিরিয়াছিলেন। রোজগারের তাগিদে তাঁহারা জব কার্ডের আবেদন করিয়াছেন। তিন কোটি নূতন আবেদন জমা পড়িয়াছিল, কিন্তু প্রতি পাঁচ জনে এক জন জব কার্ড পান নাই। আইন মানিয়া কাজের আবেদন গ্রহণ করে না পঞ্চায়েতগুলি, ফলে কাজের প্রয়োজন কতটা মিটিয়াছে, তাহা বুঝিবার উপায় নাই। যথাসময়ে পারিশ্রমিক পান নাই, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নহে— নানা অসরকারি সংস্থার নমুনা সমীক্ষা সেই ইঙ্গিত দিয়াছে। কত ভুয়া শ্রমিক কাজ করিয়াছে, কত পুকুর ‘চুরি’ হইয়াছে, তাহারও হিসাব নাই। এক দিকে টানাটানি, অপর দিকে অপচয়, এমন বৈপরীত্য লইয়া এই বিপুলাকার কর্মকাণ্ড চলিতেছে।
এই শতছিদ্রযুক্ত তরণীই আজ দারিদ্রসাগর পার হইবার একমাত্র উপায়। রাজনৈতিক মহলে কম বিতর্ক হয় নাই। প্রশ্ন উঠিয়াছিল— রাষ্ট্র দারিদ্র দূর করিবে, না কি দরিদ্রকে অনুদান-নির্ভর করিবে? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৫ সালে এই প্রকল্পকে ইউপিএ সরকারের দারিদ্র নিরসনে ব্যর্থতার ‘জীবন্ত সৌধ’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন সংসদে। অদক্ষ শ্রমিক অনবরত মাটি কাটিবে, উন্নয়নের এই ধারণার পরিবর্তে তিনি তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধি করিয়া কর্মসংস্থান বাড়াইবার খোয়াব ফেরি করিয়াছিলেন। কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমর বলিয়াছিলেন, বিজেপি সরকার দারিদ্র নিরসন করিবে, তাই দরিদ্রের সহায়তার প্রকল্পের প্রয়োজন কমিবে। বিরোধীরা মনে করাইয়াছিলেন, দারিদ্র নিরসনে এই প্রকল্পের ভূমিকা কম নহে। ২০০৪-০৫ হইতে ২০১১-১২ সালের মধ্যে গ্রামীণ দারিদ্র প্রায় ৩২% কমিয়াছে, দেড় কোটি মানুষ দারিদ্রে পতিত হইবার সম্ভাবনা এড়াইয়াছেন। একশত দিনের কাজ প্রকল্পের গুরুত্বকে খাটো করা অনুচিত, অন্যায়।
সমস্যা হইল, ক্ষুদ্র রাজনীতি অতিক্রম করিয়া বৃহত্তর উন্নয়ন পর্যন্ত বর্তমান শাসকদের দৃষ্টি সহসা প্রসারিত হইতে চাহে না। কর্মসংস্থান যোজনাও ব্যতিক্রম নহে। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে অতিমারির ধাক্কা সামাল দিতে কর্মসংস্থান যোজনাই প্রধান আয়ুধ হওয়ায় তাহার বাজেট বরাদ্দ ৬১,৫০০ কোটি টাকার উপর আরও ৭২ শতাংশ অধিক— মোট ১,১১,৫০০ কোটি টাকা খরচ হইয়াছিল। অতিমারির তীব্রতা কমিতেই এই বাজেটে বরাদ্দ কমিয়া ৭৩,০০০ কোটি টাকায় নামিয়া আসে। আবার অতিমারির ঢেউ আসায় আবারও কর্মসংস্থান যোজনার গুরুত্ব স্মরণে আসিয়াছে। আশঙ্কা হয়, তরঙ্গ মিলাইয়া গেলে প্রকল্পটির গুরুত্বও নেতারা বিস্মৃত হইবেন।