Smuggling

শিশুর মূল্য

অন্তত এক দশক যাবৎ নিখোঁজ শিশুর সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশে শীর্ষস্থানে অথবা তাহার কাছাকাছি রহিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২১ ০৪:৪৭
Share:

চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করিয়া এক দরিদ্র বিধবার শিশুসন্তান কিনিতেছেন এক নিঃসন্তান স্কুলশিক্ষিকা— ইহা কোনও তৃতীয় শ্রেণির চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য মনে হইতে পারে। আক্ষেপ, পশ্চিমবঙ্গে ইহা সংবাদের শিরোনাম। এই রাজ্যে যে শিশুবিক্রয়, শিশুপাচারের শিকড় গভীর, ডালপালা বিস্তৃত— তাহার প্রমাণ বহু বার মিলিয়াছে। সম্প্রতি বাঁকুড়ায় কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত একটি বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শিশুপাচার, এবং স্কুলশিক্ষিকার বিরুদ্ধে শিশুক্রয়ের অভিযোগ উঠিয়াছে। ২০১৭ সালে জলপাইগুড়ির একাধিক হোম হইতে শিশুবিক্রয়ের যে ঘটনা সম্মুখে আসিয়াছিল, সেখানেও মূল অভিযুক্ত ছিলেন এক প্রাক্তন স্কুলশিক্ষিকা, যিনি একাধিক বেসরকারি হোমের সহিত যুক্ত ছিলেন। জেলার শিশু সুরক্ষা আধিকারিকও ওই ঘটনায় গ্রেফতার হইয়াছিলেন। বাঁকুড়ায় পাঁচটি শিশু উদ্ধার হইয়াছে, জলপাইগুড়ির ঘটনায় অন্তত ত্রিশটি শিশু পাচার ও বিক্রয়ের সংবাদ প্রকাশ হইয়াছিল। প্রশ্ন উঠিবে যে, পুলিশ-প্রশাসন কী করিতেছিল? বাঁকুড়ার ঘটনায় এলাকার মানুষ, বিশেষত এক পঞ্চায়েত প্রধান ক্রন্দনরত দুই শিশুকে দেখিয়া সক্রিয় না হইলে হয়তো ধরা পড়িত না পাচারকারীরা। এমন ঘটনার দৃষ্টান্ত দেশের অন্যত্রও কম নহে। বিহারের মুজফ্ফরপুরের হোমে কন্যাশিশুদের ধর্ষণ, নির্যাতন ও খুনের যে চক্র সম্মুখে আসিয়াছিল ২০১৮ সালে, সেখানে কেবল হোম কর্তৃপক্ষ নহে, জেলা শিশু সুরক্ষা আধিকারিকও জড়িত ছিলেন। অভিযুক্তদের সহিত রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠতাও কার্যত একই রকম।

Advertisement

ইহাতে বিস্ময়ের কিছুই নাই। ক্ষমতাশালীর প্রশ্রয় ব্যতীত কোনও অপরাধ দীর্ঘ দিন চলিতে পারে না। অন্তত এক দশক যাবৎ নিখোঁজ শিশুর সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশে শীর্ষস্থানে অথবা তাহার কাছাকাছি রহিয়াছে। নিখোঁজ শিশুর তালিকায় প্রতি বৎসর ষোলো হাজার হইতে উনিশ হাজার শিশুর নাম উঠিতেছে। তাহাদের একটি ক্ষুদ্র অংশের নাম পাচার-তালিকাতেও স্থান পাইয়াছে। এবং, ইহা গোটা ছবিটির অংশমাত্র। পঞ্জাব-হরিয়ানার খামারে, উত্তরপ্রদেশের চুড়ি কারখানায়, রাজস্থানের পাথর খাদান অথবা অন্ধ্রপ্রদেশের ইটভাটায় যে শিশুরা কার্যত দাসশ্রমিক হইয়া দিন কাটাইতেছে, যাহারা বিবিধ শহরের যৌনপল্লিতে বন্দি, তাহাদের অধিকাংশের তথ্য সরকারের নিকট নাই। শিশুর সুরক্ষার জন্য আইন হইয়াছে, কমিশন হইয়াছে; শিশুকল্যাণে নিয়োজিত সরকারি দফতর ও বেসরকারি সংস্থাও কম নাই। তবু শিশু ক্রয়-বিক্রয়ের চক্র নিরন্তর চলিতেছে। অপরাধীদের মধ্যে কত জন আদালতের বিচারের সম্মুখীন হইয়াছে?

বন্ধ চা বাগান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-কবলিত এলাকায় আর্থিক সঙ্কটের সুযোগ লইয়া পাচারচক্র অতিসক্রিয়। সম্প্রতি অতিমারি-জনিত কর্মহীনতা শিশুদের অধিক বিপন্ন করিয়াছে। সংবাদে প্রকাশ, বাঁকুড়াতে আর্থিক অভাব ও সামাজিক অসহায়তার কারণে এক মহিলা তাঁহার তিন সন্তানকে বিক্রয় করিয়াছেন এক লক্ষ সত্তর হাজার টাকায়। এই তথ্য বেদনা ও লজ্জার। সামাজিক সুরক্ষার অর্থ যে কেবল কিছু বস্তুর বিতরণ নহে, বিপন্ন মানুষের আর্থ-সামাজিক সক্ষমতার বৃদ্ধি, এই সত্যটি যেন আমরা ভুলিতে বসিয়াছি। মানবশিশু যেখানে পণ্য হইতে পারে, সেখানে উন্নয়নের আলোচনাকে অর্থহীন বাগাড়ম্বর মনে হইতে বাধ্য।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement