ভারতের সর্বংসহ গণদেবতাও যে দুই একটি বিষয়ে ক্রুদ্ধ হইয়া উঠে, অনাহার তাহার মধ্যে একটি। সম্ভবত বহু দুর্ভিক্ষের স্মৃতি প্রজন্ম হইতে প্রজন্মান্তরে বহন করিতেছে বলিয়াই অনাহারের সম্ভাবনা মানুষকে বিচলিত করে। শুধু নিজের অনাহার নহে— অন্যেরও। সামাজিক ক্ষেত্রে অতিবিরল সর্বজনীন সহমর্মিতার একটি নির্ভুল উদাহরণ এই ক্ষেত্রে বারংবার মিলে। সেই কারণেই কোনও সরকারই ক্ষুধা বা অনাহার সংক্রান্ত পরিসংখ্যান প্রকাশ করিতে চাহে না। শীর্ষ আদালত সম্প্রতি মনে করাইয়া দিল, রাজ্যগুলি অনাহারে মৃত্যুর পরিসংখ্যান প্রকাশ করে নাই বলিয়া মৃত্যুও ঘটে নাই, ইহা ধরিয়া লওয়া চলে না। বহু মানুষ ক্ষুধার্ত থাকিতেছেন, অনাহারে মৃত্যুও ঘটিতেছে। প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণার বেঞ্চ অপুষ্টির সমস্যা হইতে পৃথক ভাবে গুরুত্ব দিয়াছে ক্ষুধাকে। ভারতে অপুষ্টি দীর্ঘ দিনের সমস্যা, খাদ্যাভাব তাহার একমাত্র কারণ নহে। খাদ্যাভ্যাস, শৌচাগার ব্যবহারের অভ্যাস, নানাবিধ অসুখ প্রভৃতি অনেক কারণের জন্য অপুষ্টি ঘটিয়া থাকে, তাই তাহার প্রতিকারের ব্যবস্থাও নিবিড় ও দীর্ঘমেয়াদি হইবে, ইহাই প্রত্যাশিত। কিন্তু ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা আপৎকালীন ভিত্তিতে করা প্রয়োজন, সেখানে সরকারি কার্যসূচির পরিচিত গয়ংগচ্ছ ভাবটি চলিবে না। বিশেষত অতিমারি এবং তজ্জনিত আর্থিক সঙ্কট ক্ষুধার প্রকোপ বাড়াইয়াছে, এই কথা নানা বেসরকারি সমীক্ষা ও পর্যালোচনায় মিলিয়াছে, কিন্তু সরকার এ বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করে নাই। এই বক্তব্যের যথার্থতা সংশয়াতীত।
তবে সরকারের কর্তব্য নিরূপণে শীর্ষ আদালতের পরামর্শটি লইয়া চিন্তার প্রয়োজন রহিয়াছে। আদালত বলিয়াছে ক্ষুধা নিবারণে কোনও নূতন প্রকল্প শুরু করা প্রয়োজন, যেমন গণরসুই চালু করিয়া রান্না করা খাবার বিতরণ। কেন্দ্র এই মডেল তৈরি করিলে রাজ্যগুলি তাহার অনুসরণ করিবে, এমনই আশা প্রকাশ করিয়াছেন বিচারপতিরা। প্রশ্ন উঠিবে, অন্নের ব্যবস্থা করা অবশ্যই সরকারের কাজ, কিন্তু তাহার জন্য কি নূতন প্রকল্প প্রয়োজন? রান্না-করা খাবার সুলভে অথবা বিনামূল্যে দিবার প্রকল্প বহু রাজ্য নানা সময়ে মহা আড়ম্বরে চালু করিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও গত বিধানসভা নির্বাচনে ‘মা’ ক্যান্টিন খুলিবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিল, কিছু স্থানে শুরুও হইয়াছিল। কিন্তু অধিকাংশ রাজ্য সে সব প্রকল্প নিয়মিত চালাইতে পারে নাই। পরীক্ষামূলক প্রকল্পের মডেল প্রয়োজন, কিন্তু গণরসুই বহু-পরীক্ষিত ধারণা। তাহার মধ্যে দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষমতা আছে, কিন্তু ক্ষুধার সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথ তাহা নহে। শীর্ষ আদালত গণরসুইয়ের জন্য রাজ্যগুলিকে বাড়তি খাদ্যশস্য জুগাইবার পরামর্শ দিয়াছে। কিন্তু গণরসুইয়ের জ্বালানি, রন্ধন-উপকরণ, রন্ধনকর্মীর পারিশ্রমিক প্রভৃতির খরচ চাল-গমের খরচকে ছাড়াইয়া যায়। অতএব কেন্দ্র কেবল বাড়তি শস্য দিয়া দায় সারিলে তাহা রাজ্যগুলির প্রতি অন্যায় হইবে।
ক্ষুধার ভয়ঙ্কর ও অসহ সমস্যার সমাধান করা জরুরি। কিন্তু, তাহার জন্য নূতন প্রকল্পও প্রয়োজন নাই, দেখনদারিও নহে। মিড-ডে মিল অথবা অঙ্গনওয়াড়ির মতো প্রকল্প দীর্ঘ দিন চালু রহিয়াছে, কিন্তু বহু রাজ্য রান্না-করা খাবার বিতরণ স্থগিত রাখিয়াছে অতিমারিতে। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মাসগুলিতে পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল, শিশু ও গর্ভবতীদের কিছুই মেলে নাই। গণবণ্টন ব্যবস্থার যে নেটওয়ার্ক ভারতে রহিয়াছে, তাহারও যথাযথ ব্যবহার হয় না। পুরাতন প্রকল্পগুলির যথাযথ রূপায়ণ না করিয়া নূতন প্রকল্প চালু করিয়া কী লাভ হইবে? ক্ষুধার নিরসনে আপৎকালীন ভিত্তিতে কাজ প্রয়োজন, সুপ্রিম কোর্টের এই কথাটি শিরোধার্য। কিন্তু কী উপায়ে তাহা হইবে, সেই সিদ্ধান্ত প্রশাসনের উপরেই ছাড়িতে হইবে।