কেন্দ্রীয় সরকারের শাসকরা ভারতকে ক্রমশই যে প্রবল প্রভুত্ববাদী রাষ্ট্রের রূপ দিচ্ছেন, সেই ভয়ানক প্রবণতাকে প্রতিরোধ করতে পারে দেশের রাজ্যগুলি। গত সপ্তাহে কলকাতায় ফেডারেশন হল সোসাইটি আয়োজিত একটি সভায় ‘ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও তার সমস্যা’ বিষয়ক বক্তৃতায় কথাটি বলেছেন অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন। দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের পাশাপাশি এই দেশেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে বিরাট বিপদের সম্মুখীন, সেই বিষয়ে তীব্র উদ্বেগের কথা তিনি দীর্ঘকাল ধরেই বিভিন্ন লেখায়, ভাষণে ও কথোপকথনে স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর আ ওয়ার্ল্ড অব ইনসিকিয়োরিটি গ্রন্থও তার বিশদ আলোচনায় সমৃদ্ধ। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই রাজ্য স্তরের প্রতিস্পর্ধী ভূমিকা সম্পর্কে এই অর্থনীতিবিদের বক্তব্যটি বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত, সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও বিভিন্ন আলোচনায় স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজ্যগুলির স্বাধিকারসচেতন প্রতিরোধকে একটি বড় ভূমিকা দিয়েছেন, তাঁর জাতীয়তাবাদের সত্যি মিথ্যে: চার্বাক উবাচ গ্রন্থে গণতান্ত্রিক ‘লোকসঙ্ঘ’ নির্মাণে রাজ্যের ভূমিকাই প্রথম এবং প্রধান হিসাবে স্বীকৃত। এক কথায়, সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদের কবল থেকে ভারতীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ফেরানো জরুরি, এবং সে-কাজ রাজ্যগুলিই করতে পারে।
রাজ্য অর্থে কেবল রাজ্য সরকার নয়। পার্থক্যটি গুরুত্বপূর্ণ। সচরাচর কেন্দ্রের আধিপত্যের বিরুদ্ধে রাজ্যের স্বাধিকারের দাবি শোনা যায় কেন্দ্রীয় শাসকদের বিরোধী দল শাসিত রাজ্য সরকারের মুখে, অনেক সময় সেই দাবি নেতিবাচক প্রতিবাদের রূপ ধারণ করে রাজ্যের স্বার্থের হানি ঘটায়। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদের অনেক আচরণেই তেমন ক্ষতি সাধিত হয়েছে। প্রণব বর্ধন অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, মোদী সরকারের প্রভুত্বকামী আচরণে বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারের স্বাধিকারও খর্বিত হয়েছে। একটি উদাহরণ— বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশ সরকারের জনকল্যাণ প্রকল্পগুলিকে ক্রমশ গ্রাস করে নিয়েছে মোদী শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের অনুরূপ নানা প্রকল্প। প্রশ্নটি এ ক্ষেত্রে নিছক রাজনৈতিক তথা দলীয় টানাপড়েনের নয়, কেন্দ্র এবং রাজ্যের আপেক্ষিক অধিকারের। রাজ্য সরকার যে দলই চালাক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এই অধিকারের দ্বন্দ্ব আছে এবং থাকবে।
ভারতে এই দ্বন্দ্বটিকে প্রায়শই আড়ালে পাঠিয়ে দেয় দলীয় রাজনীতির স্বার্থ। অধ্যাপক বর্ধন জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের যুগান্তকারী রূপান্তরের কাহিনি স্মরণ করেছেন। তাঁর বক্তব্য, যে ভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসকরা কার্যত একক ভাবে একটা রাজ্যকে লোপাট করে দিলেন, পৃথিবীর কোনও (প্রকৃত গণতান্ত্রিক) দেশে সেটা ভাবাই যায় না, অথচ তা নিয়ে কোনও রাজ্যই বিশেষ কোনও প্রতিবাদ করেনি! তর্ক উঠতে পারে যে, সংসদের নিয়ম রক্ষা করেই তো রাজ্য ভাগ করা হয়েছিল। কথাটা মিথ্যা নয়, কিন্তু অকিঞ্চিৎকর। প্রশ্ন নিয়মরক্ষার নয়, নীতি এবং আদর্শ পালনের। রাজ্য ভেঙে দেওয়া তো দূরের কথা, কোনও রাজ্যের ব্যাপারে গুরুতর কোনও সিদ্ধান্ত নিতে গেলেই যথার্থ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সেই রাজ্যের সমস্ত স্তরের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে, এবং নাগরিক সমাজের বিভিন্ন মহলের সঙ্গেও, বিশদ আলোচনার শর্ত পূরণ করতে হয়, সেটাই প্রকৃত গণতন্ত্রের দাবি। বর্তমান শাসকদের কাছে এই দাবি বা শর্ত সম্ভবত সম্পূর্ণ অর্থহীন, তাঁরা গণতন্ত্র বলতে কেবল ভোটের ফল বোঝেন। কিন্তু সমস্ত রাজ্যই যে এমন একটি ‘অকল্পনীয়’ আধিপত্যবাদী সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় কার্যত নীরব ছিল, সেটা প্রমাণ করে যে রাজ্যের অধিকারকে কোনও রাজনৈতিক দলই যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় না। নাগরিকরাও দেন কি? ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ এই প্রশ্নের সদুত্তরের উপর প্রবল ভাবে নির্ভর করছে।