শিক্ষক দিবসে নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করলেন ‘পিএম শ্রী’ স্কুলের কথা। সারা দেশে ১৪,৫৯৭ স্কুলকে ‘পিএম শ্রী’ স্কুলে উন্নীত করা হবে। কিছু কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, নবোদয় বিদ্যালয়ও হয়ে উঠবে পিএম শ্রী স্কুল, প্রস্তাবিত কর্মসূচিতে রয়েছে দেশের গ্রাম ও শহরাঞ্চলের প্রতিটি ব্লকে অন্তত দু’টি করে পিএম শ্রী স্কুল গড়ে তোলার কথাও। স্মার্ট ক্লাসরুম, থ্রি-ডি ল্যাবরেটরি, ভারী স্কুলব্যাগের বোঝাহীন পড়ুয়া— সবই নাকি হবে অত্যাধুনিক এই স্কুলের অভিজ্ঞান। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের স্কুল, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুমোদিত এই প্রকল্পের নামেও তাই ‘পিএম’। নামকরণ ও নাম বদল, নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে দুই-ই হয়ে উঠেছে শাসকের ক্ষমতা প্রদর্শনের নামান্তর, স্কুলও তার স্পর্শমুক্ত রইল না। নামের প্রশ্নে মোদী-ভক্তেরা জওহর-ইন্দিরা-রাজীবের নামে দেশের কোথায় কী আছে বা ছিল তার ফিরিস্তি দিয়ে বলেন, অটলবিহারী বাজপেয়ীর স্বপ্নের প্রকল্পের নামেও ‘প্রধানমন্ত্রী’-ই ছিল, ব্যক্তিনাম নয়, এখানেও নরেন্দ্র-র নামগন্ধ নেই, শুধু ‘পিএম’ আছে। সেটুকুও প্রয়োজন ছিল না— ক্ষেত্রটি যখন সমাজগঠন ও বিশেষত শিক্ষার, তখন পড়ুয়াদের কথা ভেবে দেশের প্রশাসনিক প্রধানের পদ-অনুষঙ্গের পরিবর্তে এমন কিছু রাখা যেত যা বিদ্যা ও জ্ঞানচর্চার স্মারক, পড়াশোনার অনুরণনবহ।
ততোধিক আপত্তি পিএম শ্রী স্কুলের গঠন-পরিকল্পনা নিয়ে। স্কুলগুলির মানোন্নয়নে আগামী পাঁচ বছরে খরচ হবে ২৭,০০০ কোটিরও বেশি টাকা। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প হলেও কেন্দ্র পুরো টাকা দেবে না, দেবে ষাট শতাংশ, বাকি চল্লিশ শতাংশ বইতে হবে রাজ্য সরকারকে। আবার, কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া টাকা রাজ্য সরকার বা জেলাশাসক মারফত আসবে না, সরাসরি স্কুলে পৌঁছবে। কেন্দ্রীয় সহায়তাপ্রাপ্ত প্রতিটি প্রকল্পের জন্য রাজ্য সরকারের বিশেষ অ্যাকাউন্ট থাকে, নিয়ম অনুযায়ী সেখানেই অর্থ পৌঁছয়, কিন্তু পিএম শ্রী স্কুলের ক্ষেত্রে তা হবে না। কেন্দ্রের এই রাজ্যকে এড়ানোর কৌশলে রাজ্যগুলির অসন্তুষ্ট হওয়া সঙ্গত, কারণ শিক্ষার বিষয়টি কেন্দ্র ও রাজ্য যুগ্ম তালিকাভুক্ত—অর্থ পরিকাঠামো পরিচালনা ইত্যাদি সংক্রান্ত যে কোনও পদক্ষেপ রাজ্যকে সঙ্গে নিয়েই করা দরকার, তাকে এড়িয়ে বা উপেক্ষা করে নয়। অন্যথায় তা সীমা লঙ্ঘন, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অসম্মান।
এ কাজ কেন্দ্র আগেও করেছে, রাজ্যকে এড়িয়ে সরাসরি জেলাশাসকের হাতে টাকা পাঠানোর উদ্যোগ করেছে, বিরোধী দলশাসিত রাজ্যগুলি তার বিরোধিতায় মুখরও হয়েছে। এ বার পিএম শ্রী স্কুল ঘিরে নতুন করে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত হলে স্কুলগুলি তথা পড়ুয়াদেরই ক্ষতি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ৪০ শতাংশ খরচ রাজ্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হবে, অথচ একুশ শতকের অত্যাধুনিক ‘মডেল স্কুল’ গড়ার কৃতিত্বের শত শতাংশ নিয়ে যাবে কেন্দ্র, এ হতে পারে না। উপরন্তু সংশয় থাকছে স্কুলগুলির ‘চরিত্র’ নিয়েও, কারণ বলা হয়েছে, পিএম শ্রী স্কুলগুলি হয়ে উঠবে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির পরীক্ষাগার। যে শিক্ষানীতিতে শিক্ষাক্ষেত্রের গৈরিকীকরণ ও ইতিহাসের বিকৃতির ঘড়া পূর্ণ হবে বলে বিদ্বজ্জন ও নাগরিক সমাজ প্রতিবাদমুখর, পিএম শ্রী স্কুলগুলির পক্ষে তার আদর্শ বিজ্ঞাপন ও নমুনা হয়ে ওঠা কোনও কাজের কথা নয়। এখনকার রাজনীতি সমাজ ও ধর্মে যে ভেদবুদ্ধির রমরমা, তার চাষ শুরু হবে শ্রেণিকক্ষ থেকে।