গমের রফতানিতে কেন্দ্রীয় নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকল। সঙ্গে যোগ হল চিনি রফতানির উপর বাধানিষেধও। ভারতই গোটা বিশ্বকে অন্ন জোগাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর এ-হেন আত্মতৃপ্ত বাক্য, এবং রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববাজারে গমের জোগান বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি সম্ভবত দিল্লির তপ্ত বাতাসে উবে গিয়েছে। গমের রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তটির পক্ষে এবং বিপক্ষে, উভয় দিকেই যুক্তি সাজানো সম্ভব। প্রথম কথা হল, দেশের বাজারে আটার দাম সর্বকালের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। এই বার অসময়ে গরম পড়ে যাওয়ায় গমের উৎপাদনও মার খেয়েছে, ফলে দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা ছিলই। রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার বাজারকে বার্তা দিল যে, গমের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার সব রকম চেষ্টা করবে। প্রত্যাশাই যে হেতু বাজারের চালিকাশক্তি, ফলে গমের দাম এমনিতে যতখানি বাড়ার ছিল, দাম বাড়তে না দেওয়ার প্রত্যাশায় তা ততখানি বাড়বে না, সরকারের তেমনই আশা। দেশে যখন আশঙ্কাজনক হারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে, তখন সাধারণ মানুষের চোখে সরকারের খাদ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা রাজনৈতিক ভাবেও ফলদায়ী হতে পারে। দুর্জনে আবার বলতে পারে যে, পঞ্জাব-উত্তরপ্রদেশের চাষিদের একটু শিক্ষা দিতেই এই নিষেধাজ্ঞা, যাতে তাঁরা ফসলের দাম না পান। রাজনীতির ময়দানে এই প্যাঁচেরও গুরুত্ব আছে, তা স্বীকার করতেই হয়। অন্য দিকে, দেশের বাজারে মূল্যস্তর নিয়ন্ত্রণ করতে আদৌ রফতানি বন্ধ করার প্রয়োজন ছিল, না কি ফুড কর্পোরেশনের গুদামে থাকা খাদ্যশস্য বাজারে ছেড়েই সেই কাজটি করা যেত, এই প্রশ্নও উঠছে। তা ছাড়াও অভিযোগ, বাজারে যখন দাম চড়ছে, তখন কৃত্রিম ভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করে চাষিদের বঞ্চিত করা তো হলই, বাজার প্রক্রিয়ার উপর সরকারের অনাস্থাটিও প্রকট হয়ে গেল।
কিন্তু, যা নিয়ে কোনও তর্ক থাকতে পারে না, তা হল সরকারের অপ্রস্তুত অবস্থা। অনুমান করার কারণ আছে যে, যখন প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববাজারে গমের জোগান অব্যাহত রাখার গালভরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন, তখন অবধি সরকারি স্তরে গম রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত হয়নি। মাত্র দু’দিনের মধ্যে এত বড় একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার অর্থ, বিষয়টিকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব না দেওয়া। ভারতবাসীর অবশ্য সে অভিজ্ঞতা আছে— নোট বাতিলের সিদ্ধান্তটি এখনও অনেকেরই শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বইয়ে দেয়। কী ভাবে দেশের বাজারে গমের মূল্যস্তর নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে বিষয়েও সম্ভবত কর্তাদের যথেষ্ট স্পষ্ট ধারণা ছিল না। এফসিআই-এর গুদাম থেকে গম বাজারে ছেড়ে মূল্যস্তর নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না, সেই বিবেচনাও সম্ভবত যথেষ্ট গুরুত্ব পায়নি। এই পরিকল্পনা ছাড়া কি আদৌ দেশের অর্থব্যবস্থা পরিচালনা সম্ভব?
বিশেষত চিনি রফতানির উপর বাধানিষেধ আরোপিত হওয়ায় আর একটি আশঙ্কা স্পষ্টতর হচ্ছে। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম আখ উৎপাদক, এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম চিনি রফতানিকারক দেশ। এই বছরও রেকর্ড পরিমাণ আখ উৎপন্ন হয়েছে। ফলে, দেশের বাজারে চিনির ঘাটতি দেখা যাবে, তেমন আশঙ্কা অন্তত এই মুহূর্তে ছিল না। অনুমান করা চলে যে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ভারত যে বেকায়দায় পড়েছে, খিড়কি দিয়ে তার থেকেই নিস্তার পাওয়ার পথ খুঁজছেন প্রধানমন্ত্রী। চিনিতে ভারত যত ভর্তুকি দেয়, তা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম উল্লঙ্ঘন করে, এই মর্মে একটি মামলায় ভারত গত ডিসেম্বরে হেরেছে। গম রফতানি নিয়েও ভারতের উপর চাপ ক্রমবর্ধমান। কিন্তু, সেই চাপের মুখে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী যদি ভারতীয় উৎপাদকদের স্বার্থরক্ষা করার বদলে খিড়কির পথ খোঁজেন, তা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। দেশবাসী প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রত্যাশা করে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।