প্রতীকী ছবি।
সর্বাপেক্ষা কম সময়ের মধ্যে ঘোষিত সরকারি সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের রেকর্ড গড়িয়া অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন জানাইলেন, বিজ্ঞপ্তিটি চোখ এড়াইয়া প্রকাশিত হইয়া গিয়াছিল! আপাতত স্বল্প সঞ্চয়ে সুদের হার কমিতেছে না। বিজ্ঞপ্তিটি রাতারাতি প্রত্যাহার করিয়া লওয়া হইল কেন, তাহা অনুমান করা চলে। পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন চলিতেছে, এই অবস্থায় বিজেপি নেতৃত্ব স্বল্প সঞ্চয়ে সুদ কমাইবার ‘অপ্রিয়’ সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করিবার সাহস দেখাইতে পারিল না। রাজনৈতিক স্বার্থের সম্মুখে অর্থনীতির যুক্তিকে পরাজয় স্বীকার করিতে হইল। ইহাই ভারতের চিরন্তন দুর্ভাগ্য। দেশ পরিচালনার ভার যাঁহাদের উপর ন্যস্ত, তাঁহারা হয় অর্থনীতির যুক্তির গুরুত্ব বুঝিতে অক্ষম; নচেৎ, বুঝিয়াও নাচার— অর্থনীতিকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে স্থান দিবার মতো সাহস তাঁহাদের নাই।
স্বল্প সঞ্চয়ে সুদের হার গত বেশ কয়েক বৎসর যাবৎ নিম্নগামী। এই বার তাহা আরও কমানো হইয়াছিল— অনুমান করা চলে, রাজ্যগুলিতে বিধানসভা নির্বাচনের পালা মিটিলে প্রত্যাহৃত বিজ্ঞপ্তিটি স্বমহিমায় ফিরিয়াও আসিবে— সুদ কমিতেছে না বলিয়া আশ্বাসটির মেয়াদ খুব জোর নির্বাচনের ঋতুটুকুই। সুদের হার কমাইবার এই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের নিকট অতি নিষ্ঠুর ঠেকিতে পারে। বিশেষত সেই প্রবীণ নাগরিকদের জন্য, যাঁহাদের বেতনও নাই, পেনশন নাই— সঞ্চিত অর্থের উপর অর্জিত সুদেই যাঁহাদের সংসার চলে। কিন্তু, সুদের হার বস্তুটির সহিত সমগ্র অর্থনীতির বিবিধ যন্ত্রাংশ এমন ভাবে জড়িত যে, এই জনগোষ্ঠীর কথা ভাবিয়া তাহাকে নির্ধারণ করিবার কোনও উপায় বাস্তবে নাই। অতিমারির ফলে ও সামগ্রিক পরিচালনার ব্যর্থতায় অর্থব্যবস্থার যে গতিভঙ্গ হইয়াছে, সেই অবস্থা হইতে উদ্ধার পাইতে হইলে শিথিল আর্থিক নীতি অপরিহার্য। অর্থাৎ, শিল্পসংস্থাগুলি যাহাতে কম সুদে ঋণ পাইতে পারে, সেই ব্যবস্থা করিতেই হইবে। ব্যাঙ্কগুলিকে যদি কম সুদে ঋণ প্রদান করিতে হয়, তবে তাহাদের পক্ষে সঞ্চয়ের উপর অধিক সুদ দেওয়া অসম্ভব— কারণ, ঋণের উপর সুদবাবদ ব্যাঙ্কের আয় কমিলে সঞ্চয়ের উপর প্রদেয় সুদবাবদ ব্যয় কমাইতেই হইবে। তাহা না করিতে দেওয়ার অর্থ, সমগ্র ব্যবস্থাটির কুশলতা নষ্ট করা।
সুদের হার কমাইবার সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে অপ্রিয়। কিন্তু, তাহা যে অপরিহার্য, এই কথাটি সাধারণ মানুষকে বুঝাইয়া বলিবার দায়িত্ব সরকারেরই। যে ভঙ্গিতে সিদ্ধান্তটি কার্পেটের নীচে লুকাইয়া ফেলা হইল, তাহাতে স্পষ্ট যে, বুঝাইয়া বলিবার অভিপ্রায় সরকারের নাই। নির্বাচন মিটিলে যখন সাধারণ মানুষ ‘ক্ষমতাহীন’ হইবেন— যখন সরকারের আর্থিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ভোট মেশিনে উগরাইয়া দিবার কোনও উপায় তাঁহাদের থাকিবে না, সিদ্ধান্তটি তখন ‘চাপাইয়া’ দেওয়া হইবে বলিয়াই অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করিতেছেন। দুর্ভাগ্য, বর্তমান জমানায় ভারতীয় অর্থব্যবস্থা এই ভাবেই চলিয়াছে। যে সিদ্ধান্তটি দেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ, এবং যে সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়, উভয় ক্ষেত্রেই এই অস্বচ্ছতা বর্তমান জমানার অভিজ্ঞান। নোট বাতিলের কু-সিদ্ধান্তই হউক, অথবা লকডাউন চালু করিবার আপাত-অপরিহার্য সিদ্ধান্ত, অথবা সুদ কমাইয়া ফের রাতারাতি তাহা বাড়াইয়া দেওয়া— কোনওটির ক্ষেত্রেই সরকার নাগরিকের সজ্ঞান সম্মতি আদায়ের চেষ্টা অবধি করে নাই। যেন মানুষকে চমকাইয়া দেওয়া, বা বোকা বানানোতেই আর্থিক সিদ্ধান্তের চরম সার্থকতা! ঘটনা হইল, এই অস্বচ্ছতায় ভারতীয় অর্থব্যবস্থার বিপুল ক্ষতি হইতেছে। সামগ্রিক ব্যবস্থার কুশলতার হানি হইতেছে, আবার সরকারি সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে অনিশ্চয়তায় বিঘ্নিত হইতেছে বিনিয়োগ বা ব্যয়ের সিদ্ধান্তও। রাজনীতির চশমা সরাইয়া দেখিলে সমস্যাগুলি প্রকট ভাবেই চোখে পড়িবে।