অবশেষে জানা গেল, ২০২৫ সালে দেশে জনশুমারির কাজ শুরু হবে; শেষ হবে পরের বছর। কী কারণে চার বছর ধরে এই মহাযজ্ঞটি বকেয়া রাখা হল, সরকার অবশ্য তার কোনও সদুত্তর দেয়নি। জনশুমারি বস্তুটি শুধু দেশের মোট জনসংখ্যা হিসাব করার কাজে লাগে না, এই শুমারি হল আক্ষরিক অর্থেই দেশের জনসংখ্যাকে চেনার পথ। কোন জনগোষ্ঠী কতখানি অসুবিধার মধ্যে রয়েছে, দেশের কোনও অঞ্চল নিয়মিত ভাবে উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে পড়ছে কি না, আগের চেয়ে কোন ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটছে আর কোথায় পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে না বা আরও খারাপ হচ্ছে, এমন সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে একমাত্র জনশুমারি। সংজ্ঞাগত ভাবেই কোনও নমুনা সমীক্ষার পক্ষে জনশুমারির বিকল্প হওয়া সম্ভব নয়। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মানচিত্র তৈরির জন্য জনশুমারির পরিসংখ্যান হল প্রাথমিকতম উপাদান। এই কাজটি ফেলে রাখায় ভারতে উন্নয়ন পরিকল্পনায় কী পরিমাণ বাধা পড়ছে, গত কয়েক বছরে সে কথাটি বহু আলোচিত। যে কোনও ক্ষেত্রেই সম্ভাব্য সংখ্যার জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে ২০১১ সালের জনশুমারির সংখ্যার প্রক্ষেপণের উপরে। যেমন, দেশে তফসিলি জাতিভুক্ত মানুষের সংখ্যা। সমস্যা হল, ২০১১ সালের শুমারি-পরবর্তী দেড় দশকে দেশের জনসংখ্যায় এই জনগোষ্ঠীর আপেক্ষিক অনুপাত কতখানি পাল্টেছে, তা সেই প্রক্ষেপণ থেকে বোঝার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। ফলে, এই জনগোষ্ঠীর জন্য আদৌ যদি কোনও উন্নয়ন পরিকল্পনা হয়, তা হবে নিতান্তই আনুমানিক।
দেশের কার্যত প্রতিটি ক্ষেত্রেই জনগণনার প্রভূত তাৎপর্য। তার মধ্যে কয়েকটি ক্ষেত্রের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। ২০২৬-এর পরে লোকসভার আসন পুনর্বিন্যাস হবে, তা এক প্রকার নিশ্চিত। আসনসংখ্যা বেড়ে ৮৪৮ হোক অথবা বর্তমান আসনসংখ্যা অপরিবর্তিত রেখে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে আসনের অনুপাত পাল্টাক, উভয় ক্ষেত্রেই পাল্লা ঝুঁকতে চলেছে উত্তর ভারতের অতি জনবহুল কয়েকটি রাজ্যের দিকে। বর্তমান প্রক্ষেপণে যে ছবিটি ফুটে উঠছে, জনশুমারি হলে তা যাচাই করে নেওয়া সম্ভব হবে। অন্য দিকে, অর্থ কমিশনের বণ্টনসূত্রে রাজ্যের জনসংখ্যা একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ হওয়ার ফলে জনবহুল রাজ্যগুলি কেন্দ্রীয় তহবিলে তাদের অবদানের অনুপাতে অনেক বেশি অর্থবরাদ্দ পেয়ে থাকে। যে রাজ্যগুলি সফল ভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করেছে, সেগুলি সেই কৃতিত্বের ‘শাস্তি’ পায়— জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম হওয়ায় তাদের বরাদ্দ ক্রমহ্রাসমান। এই জনশুমারিকে কেন্দ্র করে কমিশনের বণ্টনসূত্র পরিবর্তনের দাবি জোরদার করা বিধেয়।
তবে, এই শুমারির সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হতে চলেছে জাতিভিত্তিক গণনা। ২০১১ সালের সমীক্ষায় হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে তফসিলি জাতি ও জনজাতিভুক্ত মানুষদের সংখ্যা গণনা করা হলেও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত (আদার ব্যাকওয়ার্ড কাস্টস বা ওবিসি) মানুষের সংখ্যা গণনা হয়নি। মুসলমানরাও এই হিসাবের বাইরে থেকেছেন। পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষার অনুমান, ২০১১ সালের জনশুমারিতে যে হিসাব পাওয়া গিয়েছিল, ভারতে পিছিয়ে থাকা জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত মানুষের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। প্রকৃত হিসাবটি পাওয়া গেলে রাজনীতির ক্ষেত্রে তার তাৎপর্য বিপুল— সংরক্ষণের ঊর্ধ্বসীমা বৃদ্ধির দাবি জোরদার হবে; বর্ণহিন্দুদের স্বার্থে ঘা পড়বে। সম্ভবত এই আশঙ্কাতেই ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন অবধি জনশুমারি ঠেকিয়ে রেখেছিল বিজেপি। ভোটের ফলাফল তাদের নীতীশ কুমারের জেডি(ইউ)-এর মুখাপেক্ষী করেছে। ওবিসি-গণনায় তাদের রাজনৈতিক আগ্রহ প্রচুর, ফলে বাইরে কংগ্রেস-সহ বিভিন্ন বিরোধী দল ও ভিতরে জেডি(ইউ)-এর চাপ রয়েছে বিজেপির উপরে। এই শুমারিতে ওবিসি গণনার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হলে তা ভারতীয় রাজনীতিকে একটি নতুন মোড়ে নিয়ে যাবে।