খাদ্যশস্য। ফাইল চিত্র।
দুয়ারে রেশন’ প্রকল্প খাদ্যের অধিকার আইনের পরিপন্থী, তাই তা বন্ধ করার নির্দেশ দিল কলকাতা হাই কোর্ট। এ হয়তো মন্দের ভাল, কারণ সেই প্রকল্পের খরচের বহর সামলানো কঠিন হচ্ছিল সরকারের পক্ষে। সেই খরচটি খাদ্যশস্য ক্রয়ের জন্য নয়, তা দুয়ারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কেবল রেশন ডিলারদের কমিশন দিতে মাসে দশ কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছিল করদাতাদের। বিনামূল্যে রেশন সরবরাহের জন্য যেখানে ১৪০০ কোটি টাকা খরচ ধার্য করেছে রাজ্য সরকার, সেখানে কেবল ‘দুয়ারে রেশন’ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করেছিল ১২০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, খাদ্যশস্য ক্রয় ও বণ্টনের বরাদ্দের প্রায় সমান পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল কেবল তা রেশন দোকান থেকে গ্রাহকের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কোন যুক্তিতে এত সামান্য সুবিধার জন্য এই বিপুল খরচকে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কেনই বা তাতে সায় দিয়েছিলেন তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা, আজ অবধি রাজ্যবাসী তা জানতে পারল না। রেশনের দোকানে লাইন দেওয়ার হয়রানি থেকে গ্রাহককে মুক্তি দেওয়াই যদি সরকারের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তা হলে আরও বেশি সংখ্যায় রেশন দোকান খোলা যেত। দোকান খোলা রাখার সময়ে নমনীয়তা রাখতে, বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যক্তি বা সহায়হীন বৃদ্ধদের সহায়তার নির্দেশ দিতে পারত সরকার। গ্রাহকের প্রধান দাবি বরাবরই ছিল খাদ্যের সঠিক মান, পরিমাণ ও নিয়মিত সরবরাহ। সে দিকে নজর না দিয়ে ‘দুয়ারে রেশন’ পৌঁছতে কেন এত ব্যগ্র হয়ে উঠল রাজ্য সরকার?
আন্দাজ করা চলে, তাগিদটি যতখানি উন্নয়নমুখী, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। ‘দুয়ারে সরকার’ কার্যসূচির সাফল্য আরও বেশি সরকারি পরিষেবা ‘দুয়ারে’ পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ তৈরি করেছিল। পরিষেবার এমন ‘ব্র্যান্ডিং’ নির্বাচনের সময়ে তৃণমূলের রাজনৈতিক প্রচার হয়তো আরও জোরালো করতে পারত। সমস্যা হল, বাহবা পাওয়ার তাড়নায় আইন, নীতি, প্রশাসনিক পদ্ধতি, কিছুই খুঁটিয়ে দেখার সময় পাননি নেতারা। ফলে ঘটেছে হিতে বিপরীত। খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, অথচ বহু গ্রাহকের কাছে রেশন সংগ্রহের ঝক্কি বেড়েছে। উপভোক্তার অধিকারগুলি অনেক ক্ষেত্রে সুরক্ষিত হয়নি বলেও তাঁরা ক্ষুব্ধ। অন্য দিকে, বাড়তি কমিশন পেয়েও পরিবহণ ও বণ্টনের বাড়তি ঝক্কি পোহাতে নারাজ রেশন ডিলাররা। তাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন নানা আইনি অসঙ্গতি দেখিয়ে। হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারে। তবু মূল প্রশ্নটা রয়েই যায়— কোনও জনহিতকর প্রকল্প শুরুর আগে কেন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে না সরকার? কেন চায় না সবার মতামত, কেন শোনা হয় না আপত্তি বা আশঙ্কা, কেন আগাম সতর্কতা নেওয়া হয় না আইনি বিপর্যয় এড়াতে?
সেই প্রশ্নগুলির উত্তর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ জানেন। উত্তরটির নাম রাজনীতি। যে কোনও প্রকল্প থেকেই রাজনৈতিক লাভ অর্জনের তাগিদ। আগাম বিবেচনার অভাবে গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গে নানা সরকারি প্রকল্পের রূপায়ণ থমকে গিয়েছে। কখনও তা আইনের সঙ্গে সংঘাতের জন্য, কখনও কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধতার জন্য, কখনও প্রশাসনিক রীতি লঙ্ঘনের জন্য। নলবাহিত পানীয় জলের প্রকল্পে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ আটকে গিয়েছিল রাজ্য সরকার প্রকল্পের পৃথক নামকরণ করায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পুনর্নিয়োগ সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করেছে, স্কুল সার্ভিস কমিশনের গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি নিয়োগে বেনিয়ম ধরেছে বাগ কমিটি। সর্বোপরি, শিক্ষক নিয়োগে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নিয়মভঙ্গের বহর প্রশাসনিক শৃঙ্খলার সব সীমা অতিক্রম করেছে। আইনের শাসনকে সরকারই যদি এ ভাবে লঙ্ঘন করে, ক্ষতি নাগরিকের।