জিতিল পশ্চিমবঙ্গ। জিতিলেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। বিভেদের বিরুদ্ধে এই জয় সম্প্রীতির, অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর। আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এই জয় বাঙালি সত্তার। এই মাটি চৈতন্যদেবের, লালন ফকিরের, শ্রীরামকৃষ্ণের, স্বামী বিবেকানন্দের। এই মাটি যতখানি ডিরোজিয়োর, ততখানিই বিদ্যাসাগরের; রবীন্দ্রনাথের যতখানি, ততখানিই নজরুলেরও। নির্বাচনে জিতিল বাংলার সেই মাটি, যাহা ইতিহাসের প্রতিটি পর্বে উদারবাদকে ধারণ করিয়াছে, বহুত্ববাদকে ধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দিয়াছে, নবজাগরণের অগ্রপথিক হইয়াছে। এই জয় প্রমাণ করিল যে, নবজাগরণের চেতনা বাংলার প্রান্তে-প্রান্তরে প্রবেশ করিয়াছে— মানুষের মজ্জায় মিশিয়াছে, রক্ত হইয়া শিরা-ধমনীতে ছুটিয়াছে— এই চেতনা কোনও বিশেষ ‘আলোকপ্রাপ্ত’ শ্রেণির কুক্ষিগত হইয়া থাকিয়া যায় নাই। শিরা-ধমনীতে ছুটিয়া বেড়ানো এই শুভবোধ, এই উদারচেতনাই বাঙালিত্বের নির্যাস। এই নির্বাচনে জিতিল সেই বাঙালিত্ব। বৃহৎ বাঙালিত্ব। সমস্ত আশঙ্কাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করিয়া বাঙালি ‘বঙ্গভঙ্গ’ রুখিয়া দিল— ধর্মের ভিত্তিতে, বা অন্য কোনও পরিচিতির ভিত্তিতে রাজ্যকে ভাগ হইতে দিল না। বাঙালির অভিনন্দন প্রাপ্য।
প্রতিটি নির্বাচনেই পরীক্ষা হয়, শাসকরা যে পথে রাজ্য চালাইয়াছেন, তাহাতে রাজ্যবাসীর সম্মতি আছে কি না। এই নির্বাচনে আরও একটি মাত্রা ছিল— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে পথে রাজ্যকে পরিচালনা করিতেছেন, বিজেপি তাহার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ এক বিকল্প পথের প্রস্তাব লইয়া জনতার দরবারে গিয়াছিল। কোন মডেলে রাজ্য আস্থা পোষণ করিতেছে, এই নির্বাচন সেই প্রশ্নেরও উত্তর দিল। রাজ্যবাসী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি আস্থা প্রকাশ করিয়াছেন। যে ভঙ্গিতে তিনি উন্নয়নের একটি বিকল্প মডেল তৈরি করিয়াছেন, প্রশাসনকে ক্রমশ মানুষের দুয়ারে লইয়া যাইবার কথা বলিয়াছেন, যে ভাবে বিশেষত দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিনতার সহিত সরকার ও প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করিয়া লইয়াছেন, নির্বাচনের ফলাফল তাহার সেই কর্মপদ্ধতিতে রাজ্যের মানুষের আস্থা পোষণের কথা বলে। অনেকেরই অনুমান, এই নির্বাচনে অধিকতর সংখ্যক মহিলা তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়াছেন। অনুমানটি যদি সত্য হয়, তবে তাহাও একটি আস্থার কথা বলে— সংসার চালাইবার দায়িত্বে মহিলারা এই সরকারকে পার্শ্বে পাইয়াছেন। ইহাকে ‘খয়রাতির রাজনীতি’ বলিয়া উড়াইয়া দিতে চাহিলে ভুল হইবে— সরকার কী ভাবে রাজ্যবাসীর পার্শ্বে থাকিতে পারে, এবং উন্নয়নের আকৃতি কী হইতে পারে, তাহার নূতন কল্পনার দিগন্ত খুলিয়া গিয়াছে রাজ্যে। তাহা যে ফলপ্রসূও হইয়াছে, উন্নয়নের সূচকে তাহার প্রমাণ আছে।
বাঙালি কী প্রত্যাখ্যান করিল, তাহাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। পরিচিতির ভিত্তিতে বিভাজনের চেষ্টা, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব কাড়িয়া লইবার কু-পরিকল্পনা ইত্যাদি তো বটেই, একই সঙ্গে প্রত্যাখ্যাত হইল বিষাক্ত পৌরুষ, কদর্যতা ইত্যাদিও। দিনের পর দিন বিজেপির নেতারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্বন্ধে যে কু-ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করিয়াছেন; যে ভঙ্গিতে প্রধানমন্ত্রী ‘দিদি, ও দিদি’ বলিয়া টিটকারি করিয়াছেন একের পর এক জনসভায়; দিলীপ ঘোষ আদি নেতারা যে ভাষায় মহিলাদের প্রসঙ্গে ও সঙ্গে কথা বলিয়াছেন— নির্বাচনের ফল বলিল, বাঙালি তাহাকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। এক কথায়, উগ্র পুরুষতান্ত্রিক হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থানের যে সংস্কৃতি, বাংলার মাটিতে বাঙালি তাহাকে প্রবেশাধিকার দেয় নাই। বাংলা সম্বন্ধে গর্ববোধ না করিয়া উপায় নাই। একই সঙ্গে মনে রাখিতে হইবে, এই আস্থার সম্মানরক্ষার দায়িত্বটি কঠোর, এবং অবশ্যপালনীয়। সকলকে আপন করিয়া, সর্বজনীন উন্নয়নের পথে হাঁটিবার পক্ষে রায় দিয়াছে বাংলা। তাহা হইতে যেন রাজ্য মুহূর্তের তরেও বিচ্যুত না হয়।