ভোটের প্রতিশ্রুতি। ফাইল চিত্র।
ভোটের গাজর কিছু নতুন বস্তু নয়। ভোটের আয়ু যত, গাজর ঝোলানো অর্থাৎ ভোট-প্রতিশ্রুতির ঝুড়িটির আয়ুও ততই— হিসাব কষলে দেখা যাবে। তবে গাজরের আকারপ্রকার সব কালে সব দেশে সমান নয়। কিছু কিছু নির্ভীক উদ্দাম রাজনৈতিক দল যে কোনও মহাগুরুতর বিষয়কেও ভোটের গাজরে পরিণত করতে পারে। বিজেপি তেমন একটি দল। আপাতত তারা নিজেদের পারদর্শিতা দেখাচ্ছে— গুজরাত এবং হিমাচল প্রদেশ, দুই রাজ্যেই একের পর এক প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে, অনেক ক্ষেত্রেই যে প্রতিশ্রুতির ভিত্তি অত্যন্ত ক্ষীণ এবং দুর্বল। উদাহরণ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার আশ্বাস। বিষয়টি শুনতে অতি মনোহর, কিন্তু সাংবিধানিক কারণে তার পথটি এতই কণ্টকাকীর্ণ যে, কী করে গুজরাত এবং হিমাচল প্রদেশে বিজেপি নেতারা সহর্ষে সরবে প্রচার করছেন আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এলেই তাঁরা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সেই রাজ্যে চালু করে দেবেন— দেখে বিস্ময় জাগে। বিজেপির সর্বভারতীয় প্রেসিডেন্ট জে পি নড্ডা দুই রাজ্যেই বলেছেন, দেশে ‘ঐক্য’ প্রতিষ্ঠার জন্য ‘অভিন্নতা’ প্রচার করা জরুরি। বলেছেন, ভারতে বহু ধর্ম, বহু গোষ্ঠী, সেই কারণেই এই অভিন্ন বিধি অতীব প্রয়োজন, রাষ্ট্রের চোখে নাগরিকের সমতা তৈরির লক্ষ্যে।
নাগরিকের সমতা তৈরির লক্ষ্যটি মোটেই ফেলনা নয়, বরং অতীব জরুরি। গণতান্ত্রিক আবহ তৈরির জন্যই তা একেবারে মৌলিক ও প্রাথমিক শর্ত। কেবল নড্ডা এবং তাঁর দল নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলও বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করেছে। তবে এতে জটিলতাও কম নয়। ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত সংখ্যালঘুর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অধিকার যে শর্তহীন ভাবে সমর্থন করা হয়েছে, তাতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের পার্সোনাল ল-র পক্ষে সাংবিধানিক যুক্তি দর্শানো সম্ভব। কোথায় সেই আইন ব্যক্তি-অধিকারকে বিপন্ন করে, এবং তাই জন্য নাগরিকের প্রাপ্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কোথায় স্থাপন করা দরকার— এ সব শেষ পর্যন্ত রাজনীতির প্রশ্ন নয়, সাংবিধানিক প্রশ্ন, কেননা সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষাও গণতন্ত্রের একটি মৌলিক শর্ত। দ্বন্দ্ব এখানেই। সম্প্রতি বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে নতুন করে আলোচিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় আইন ও বিচার মন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলেছেন, এ বিষয়ে নীতি প্রণয়নের জন্য আলাদা কমিশন তৈরি করতে হবে। অর্থাৎ অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হলেও সেই অভিমুখে এগোনোর কাজটি সহজ নয়। অভিন্ন বিধি কবে, কত কাল পরে, কোন পদ্ধতিতে চালু করা সম্ভব, দুঁদে আইনজীবীরাও এখন তা বলতে পারবেন না। তাই, চটজলদি ভোটের প্রতিশ্রুতির মধ্যে তাকে ঢুকিয়ে ফেলার মূলে আছে এক বিরাট প্রতারণা।
কেন্দ্রীয় শাসক দল যখন কোনও রাজ্য নির্বাচনী প্রচারে এমন কাজ করে, তখন এই প্রতারণা আরও বড় আকার নেয়। সমগ্র বিষয়টির মধ্যে নাগরিককে বুঝেশুনে বিপথচালিত করার চেষ্টাটি দুর্ভাগ্যজনক। গুজরাত ও হিমাচল প্রদেশের শুভবোধসম্পন্ন নাগরিক প্রশ্ন করতেই পারেন, ২০১৯-এর বিজেপি নির্বাচনী ইস্তাহারে তো অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রতিশ্রুতি ছিল, এখনও তা করা গেল না কেন। সমস্যা হল, এ প্রশ্ন তুলতে পারেন, এমন নাগরিকের সংখ্যা হাতেগোনা। অধিকাংশ মানুষের মনেই এই সব বক্তব্য সহজে যে মনোভাব তৈরি করে, তার নাম মুসলমানবিদ্বেষ। আর, তখন স্বভাবতই সেই বিদ্বেষবিষে সেঁকা বিজেপির সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প নির্বাচনী জয়লাভের স্বপ্নে বিভোর হতে পারে। কে না জানে, বহুসংস্কৃতিসমৃদ্ধ এই গণতান্ত্রিক দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তৈরির সঙ্গত বিতর্কটি এখন রাজনৈতিক হিন্দুত্বের হুঙ্কারের ফলে হয়ে দাঁড়িয়েছে— সংখ্যালঘুকে শাসানি দেওয়া ও সংখ্যাগুরুকে মুসলমান-বিদ্বেষে নিষিক্ত করার ন্যক্কারময় পন্থা।