প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিনে স্মৃতিচারণা। ছবি: সংগৃহীত।
আজ প্রতিমাদির জন্মদিন। কত স্মৃতি রয়েছে ওঁকে ঘিরে। মনে আছে, ছোটবেলায় দু’জনের গানই আমি শুনতাম— লতা মঙ্গেশকর ও প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। আসলে প্রতিমাদির কণ্ঠ একেবারে অন্য রকম ছিল। আমার বাবা (পণ্ডিত হরিহর শুক্লা) সঙ্গীত জগতেরই মানুষ ছিলেন। বাবা কিন্তু সব ধরনের গান শুনতেন। বাবার কাছেই একটা ঘটনা শুনেছিলাম প্রতিমাদিকে নিয়ে। প্রতিমাদি তখন সদ্য কলকাতায় এসেছেন। বাঁশির মতো কণ্ঠ ওঁর। কমল দাশগুপ্ত বাবাকে বলেছিলেন, “একজন নতুন মেয়ে গাইবে। হরিহর, তুমি একটু তবলা নিয়ে বসো।” বাবা বলেছিলেন, প্রতিমাদি যেই গান গাইতে শুরু করেছেন, তাঁর হাত আর চলছিল না। তবলা বাজাতেই পারছিলেন না। প্রতিমাদির সুরেলা ও মিষ্টি কণ্ঠ শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন বাবা। তবলা আর বাজাতে পারেননি। তবলা ছাড়াই গান গেয়েছিলেন সে দিন প্রতিমাদি।
তবে প্রতিমাদি যখন গাইতেন, আর অন্য কিছু ভাবতেন না। গান কেমন হচ্ছে, এ সব তাঁর ভাবনাতে আসত না গান গাওয়ার সময়। শুধুই গেয়ে যেতেন। আমাকে প্রতিমাদি খুব ভালবাসতেন। ছোটবেলায় আমাকে দেখাশোনার ভার ছিল যাঁর উপর, দেখা হলেই তাঁকে প্রতিমাদি বলতেন, “হৈমন্তীকে দেখবে ঠিক করে। ওর যেন কোনও কষ্ট না হয়।” গানবাজনা নিয়েও প্রতিমাদির সঙ্গে কত কথা হত! শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়েও আলোচনা হত। তিনি ভরসা করে বলতেন, “রাগপ্রধান গান হৈমন্তী একেবারে ঠিক গাইবে। ও খুব ভাল গায়।”
প্রতিমাদি কিন্তু আত্মভোলা মানুষ ছিলেন। গান তো ভাল গাইতেনই। মানুষ হিসাবেও খুব সহজ-সরল ছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, শেষের দিকে ওঁর কিছু মানসিক সমস্যা হয়েছিল। বিশেষ করে কারও মৃত্যুর খবর পেলে সহ্য করতে পারতেন না, অস্বাভাবিক আচরণ করতেন প্রতিমাদি। শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সুরে প্রথম গান রেকর্ড করেছিলাম। শৈলেনদার মৃত্যুর খবর দিতে গিয়েছিলাম প্রতিমাদিকে। তখন আমার দিকে তেড়ে এসেছিলেন। প্রায় চড় মারতে গিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “এ সব বাজে কথা কে তোকে বলেছে? শৈলেন তো আছে।”
আবার বাড়িতে আমি বা অন্য কোনও অতিথি গেলে প্রতিমাদি কিন্তু যত্ন করে খাওয়াতেন। খুব মনে পড়ে আজও প্রতিমাদির কথা। আজকের যুগেও যদি প্রতিমাদি থাকতেন, সকলের গান শুনেই বলতেন, ‘যা হচ্ছে খুব ভাল হচ্ছে। আমি তো এগুলো গাইতে পারতাম না।’ আমার বিশ্বাস তিনি এমনই বলতেন। গায়ে আঁচল জড়িয়ে গান গাইতেন। দেখলে বোঝাই যেত না, তিনি গান গাইছেন।
একটা দেশাত্মবোধক গানের রেকর্ডিং ছিল প্রতিমাদির সঙ্গে। হঠাৎ সেই দিন থেমে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “আমার অংশটা পরে রেকর্ড করব। আজ হৈমন্তীর গানটা শুনি।” কিন্তু সেই প্রতিমাদি আমাকে আর চিনতে পারলেন না, সে দিন শেষ বারের মতো দেখা করতে গিয়েছিলাম। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “প্রতিমাদি ভাল আছেন?” আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলেন, “আপনি ভাল আছেন?” চিনতে পারেননি সে দিন তিনি আমাকে। মানসিক সমস্যা শুরু হয়েছিল। অথচ, এক বার গান গাইতে বসে গেলে, কোথাও কোনও বিচ্যুতি নেই।