—প্রতীকী চিত্র।
লাল কেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশের একতা, সব নাগরিকের প্রতি সমদৃষ্টি, নারীর সম্মান বিষয়ে যে কথাগুলি বললেন, দেশের প্রতিটি নাগরিক তাতে বিশ্বাস করতে চাইবেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কি কথাগুলিতে আদৌ বিশ্বাস করেন? যে দিন তিনি দেশের একশো চল্লিশ কোটি মানুষের উদ্দেশে কথাগুলি বললেন, সেই ১৫ অগস্টই গুজরাত সরকার সিদ্ধান্ত নিল যে, বিলকিস বানো মামলায় শাস্তিপ্রাপ্ত এগারো জনকে মুক্তি দেওয়া হবে। এক অপরাধীর আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছিল; সরকারি প্যানেল নির্দ্বিধায় এই অপরাধীদের মুক্তি দিয়েছে। তারা যে সে অপরাধী নয়— ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গার সময় অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস বানোকে গণধর্ষণ, তাঁর চোখের সামনে তিন বছরের সন্তানকে আছড়ে হত্যা, পরিবারের আরও দশ সদস্যকে খুন করেছিল সেই অপরাধীরা। সেই অপরাধের নৃশংসতার বর্ণনাতেই শিউরে উঠতে হয়; মানুষ যে এতখানি নিষ্ঠুর, এত মনুষ্যত্বহীন হতে পারে, তা বিশ্বাস করাই দুষ্কর। সেই অপরাধীদের মুক্তি দিল গুজরাতের বিজেপি সরকার। এত বড় একটি ঘটনা কি প্রধানমন্ত্রীর অজ্ঞাতে হওয়া সম্ভব? যদি তাঁর জানাই থাকে যে, ১৫ অগস্ট দিনটিতেই গণতন্ত্রের সর্বাঙ্গে এতখানি কালি মাখিয়ে দেবে তাঁরই দলের সরকার, তার পরও লাল কেল্লায় দাঁড়িয়ে সমদর্শিতার কথাগুলি বলেন কোন মুখে? না কি, যে ভারতের কথা তিনি বলেছেন, তা গোলওয়ালকর-কল্পিত ভারত, যে ভারতে মুসলমানদের নাগরিকত্ব বড় জোর দ্বিতীয় শ্রেণির? কোনও সমদর্শিতার, কোনও ন্যায়বিচারের দাবি তাঁরা করতেই পারেন না? লাল কেল্লায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী কি সেই ভারত প্রতিষ্ঠারই সমাচার শুনিয়ে গেলেন?
ধর্ষক ও খুনিদের এই মুক্তি সংশয়াতীত ভাবে বার্তাবহ। প্রথম বার্তা, এই দেশে বর্তমান শাসকরা সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের অধিকার স্বীকার করেন না। অপরাধীরা মুক্তি পাওয়ার পর বিলকিস প্রশ্ন করেছেন, তা হলে এ দেশে কি এ ভাবেই বিচার শেষ হবে? এই গৈরিক ভারতবর্ষে প্রশ্নটির উত্তর হাওয়ায় ভাসছে। দ্বিতীয় বার্তাটি হল, রাষ্ট্রের চোখে কোনও সাম্প্রদায়িক অপরাধে কোনও হিন্দু অপরাধী হিসাবে প্রতিভাত হবে না। এই ইঙ্গিতটি দিল্লি, উত্তরপ্রদেশে বারে বারেই মিলছিল— গুজরাতে তার উপর সংশয়াতীত সিলমোহর পড়ল। যারা মুক্তি পেয়েছে, তাদের অপরাধ প্রমাণিত। তাদের চেয়ে অনেক কম নৃশংস অপরাধে অভিযুক্তদের সাজা মকুবের আবেদন সঙ্গত কারণেই গ্রাহ্য করা হয় না। কেউ অবশ্য বলতেই পারেন যে, বর্তমান ক্ষেত্রে অপরাধীদের মুক্তি দেওয়া হল, কারণ তাদের অপরাধটি ছিল সংখ্যালঘু মানুষদের বিরুদ্ধে।
হায় ভারত! ধিক্ তার নাগরিকদের, ন্যায়বিচারের এ-হেন অবমাননার পরও যারা ক্ষোভে ফেটে পড়ে না, এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বশক্তিতে চিৎকার করে না। ধিক্ সেই বিরোধী রাজনীতিকে, যা এখনও নিশ্চুপ থেকে লাভ-ক্ষতির ক্ষুদ্র হিসাব কষে। এই মুক্তিপ্রাপ্ত দুষ্কৃতীদের অপরাধ শুধু এক মহিলার বিরুদ্ধে নয়, একটি পরিবারের বিরুদ্ধে নয়— এই অপরাধ মানবতার বিরুদ্ধে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বলেই অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে গণধর্ষণ, মায়ের সামনে সন্তানকে নিষ্ঠুরতম পন্থায় হত্যা করা— এমন আচরণকারীদের মানবতার শত্রু ভাবা যাবে না, এমনকি অপরাধের পরিমাণটিও গুরু ভাবা যাবে না? প্রশ্নটি অলঙ্কারমাত্র। উত্তর হল, হ্যাঁ এইখানেই এসে দাঁড়িয়েছে ৭৫ বছর বয়সি ‘অমৃত’ ভারত। যে ভারতের সর্বজনমনমোহন নেতা অক্লেশে মহৎ ও বৃহৎ ঘোষণার পাশে নিষ্ঠুর আক্রমণকারীদের সাজামুক্তিতে নীরব থাকতে পারেন, যে ভারতে এমন ঘটনাতেও নাগরিক বিন্দুমাত্র বিরক্ত হন না, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে সেই দেশ আজ উদ্ভাসিত।