Norwesters

প্রতীক্ষা

বিরহী যক্ষ মেঘকে দূত করিয়াছিল। মেঘের নিকট দৌত্য করিবে কে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২১ ০৪:৫১
Share:

প্রতীকী ছবি।

আসিয়াও যেন সে আসিতেছে না, আভাস মিলিতেছে শুধু। কোথায় সেই মহাসমারোহ? ঘন নীলাঞ্জন কান্তি চক্ষু ভুলাইবে, গম্ভীর স্বরে শ্রবণ সচকিত হইবে, মেদিনীর আদিম ঘ্রাণ চিত্ত ব্যাকুল করিবে, শিহরিত হইয়া জাগিয়া উঠিবে অন্তঃকরণ, তবেই তো যথাবিধি অভিষেক হইবে বাংলা নববর্ষের। হায়, অর্ধেক বৈশাখ অতিক্রান্ত হইল, কালবৈশাখী তাহার পূর্ণৈশ্বর্য লইয়া আবির্ভূত হইল না। দক্ষিণবঙ্গের কোনও কোনও জেলায় সন্ধ্যার মুখে ঝড়বৃষ্টি হইয়াছে বটে। কিন্তু গুরুগুরু গগনভেরি বাজাইয়া সেই আগমন, নিশ্চিন্ত সংসারযাত্রাকে নিমেষে লন্ডভন্ড করিয়া হা-হা হাস্যে মিলাইয়া যাইবার কৌতুক, কবে ফের দেখা দিবে? স্বৈরাচারী শাসকের ন্যায় প্রবল গ্রীষ্ম একাই রাজত্ব করিতেছে, তাহার প্রতিস্পর্ধীর দেখা নাই। জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, কালবৈশাখীর অনুকূল পরিবেশ তৈরি হইয়া আছে। কিন্তু বায়ুমণ্ডলে যে রূপ পরিস্থিতিতে তাহার শক্তি প্রবল হইয়া উঠে, তাহা এখনও দেখা যায় নাই। গত কয়েক বৎসর ফাল্গুনেই সে দেখা দিয়াছিল ঈশান কোণে, এ বার আসে নাই। চৈত্রের শেষে এক বার মহানগরীর আকাশ ঘন হইয়া আসিয়াছিল বটে, কিন্তু হরিষে বিষাদ। বাগাড়ম্বর-প্রিয় নেতার ন্যায়, অনেক আশ্বাসের শেষে এক পশলা শীতল হাওয়া, আর দুই বিন্দু বৃষ্টি দিয়াই মেঘপুঞ্জ অন্তর্হিত হইল। পশ্চিমের জেলাগুলিতে যদি বা কিছু ঝড়জল হইয়াছে, কলিকাতার মানুষের চাতক-দশা ঘোচে নাই। সময় যায় নাই— বৈশাখের শেষে, জ্যৈষ্ঠের শুরুতে কালবৈশাখী অধিক হয়।

Advertisement

প্রকৃতি বাধ্য স্কুলছাত্র নহে, সে আপন খেয়ালে চলে। কিন্তু মানুষ কি প্রকৃতির আপন ছন্দ ব্যাহত করিল? মানুষের কার্যকলাপ নিবিড় বাস্তুতন্ত্র এবং জলবায়ুতে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আনিতেছে। পূর্বের নিয়ম হইতে কিছু বিচ্যুতি ইতিমধ্যেই প্রকট হইয়াছে। একবিংশ শতাব্দীতে গ্রীষ্ম প্রলম্বিত হইয়াছে, তাপমাত্রা দ্রুত বাড়িতেছে। ঘূর্ণিবাত্যা আরও ঘন ঘন ধাইয়া আসিতেছে, তাহার বিধ্বংসী শক্তি যেন বাড়িতেছে। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে মৌসুমি বায়ুর সহিত বর্ষার আবির্ভাব কেবল বিলম্বিত হয় নাই, বর্ষণের ধরনও বদলাইয়াছে। পূর্বে অনেকটা সময় ধরিয়া হালকা ও মাঝারি বর্ষণ হইত, ফসলের পক্ষে তেমন বর্ষণই উপকারী। এখন হঠাৎ হঠাৎ তীব্র বর্ষণ হইয়া যায়, মাটি তাহা গ্রহণ করিবার পূর্বেই আল উপচাইয়া জল ভাসিয়া যায়, লইয়া যায় উর্বর মাটি। লাভের চাইতে ক্ষতির পাল্লা অধিক হইয়া পড়ে কৃষকের।

কিন্তু ঝড়বৃষ্টি, মেঘ-সূর্য তো কেবলই কাজে লাগাইবার বস্তু নহে। তাহাদের আসা-যাওয়ার ছন্দে মানুষের জীবন স্পন্দিত হয়, ঋতুর আবির্ভাবের উদ্‌যাপনে উৎসব পালন। যুগ যুগ ধরিয়া শিশুরা শিলাবৃষ্টি দেখিয়া মহা কলরবে শিল কুড়াইতে নামিয়াছে, কালবৈশাখী বহিয়া গেলে আম কুড়াইতে ছুটিয়াছে, ধারাস্নানের আনন্দে মাতিয়াছে। সাহিত্য-চলচ্চিত্র বাহিত হইয়া সেই সকল আমোদ-উচ্ছ্বাস বাঙালির সামূহিক চেতনায় প্রবেশ করিয়াছে। যে নিজে সে সকল উৎসবে অংশ লইতে পারে নাই, সে-ও যেন তাহার স্পর্শ অন্তরে অনুভব করিয়াছে। কালবৈশাখী সামূহিক স্মৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই মহানগরীর জনারণ্যে বাস করিয়াও মন উৎসুক হইয়া থাকে— ওই বুঝি ভৈরব হরষে সে আসিল। বিরহী যক্ষ মেঘকে দূত করিয়াছিল। মেঘের নিকট দৌত্য করিবে কে?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement