প্রতীকী ছবি।
আবারও পথ দেখাইল বাংলা। গত এক মাসে কোভিডে মৃত তিন ব্যক্তির দেহে ‘প্যাথলজিক্যাল অটোপ্সি’ বা চিকিৎসা বিষয়ক ময়নাতদন্ত হইল। এশিয়ায় এই প্রথম। বিগত এক বৎসরে এই প্রকার মৃত্যুর ফলে বহু দেহদানের অঙ্গীকার ব্যর্থ হইয়াছে। স্মরণীয়, ১৮৩৬ সালে কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজে দেশের প্রথম শব ব্যবচ্ছেদটি করিয়াছিলেন বাঙালি চিকিৎসক মধুসূদন গুপ্ত। জাতিচ্যুত হইবার হুমকি সত্ত্বেও বিজ্ঞানের সাধনা করিয়াছিলেন, সংগ্রাম করিয়াছিলেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের বিরুদ্ধে। এমন সার্বিক বিজ্ঞানমনস্কতাই বাংলার উত্তরাধিকার। তাহা রামমোহন-বিদ্যাসাগরের ঐতিহ্যে প্রবাহিত। করোনার প্রথম ঢেউয়েই শব ব্যবচ্ছেদ করিয়াছিলেন ইটালির চিকিৎসকেরা। ভাইরাসের আক্রমণে দেহের কোন অঙ্গ কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে, কোষে কী প্রকার পরিবর্তন ঘটিতেছে, তাহার প্রভাব সমগ্র দেহে কতখানি পড়িতেছে ইত্যাকার সকল প্রশ্নের জবাব খুঁজিয়াছিলেন তাঁহারা। ব্যবচ্ছেদের পর ‘কো-মর্বিডিটি’ থাকা ও না-থাকা দেহের নমুনা লইয়া তুল্যমূল্য আলোচনা গবেষণাপত্রে প্রকাশও করিয়াছিলেন। ইউরোপ যাহাতে অনেকখানি বিকশিত, এযাবৎ কাল এশিয়াতে তাহার সূচনাটুকুও হয় নাই, বিজ্ঞানের অগ্রগতির অভিজ্ঞান হইল কলিকাতা।
বস্তুত, বহু দশক ধরিয়া দেহদানে আলোকবর্তিকা প্রজ্বলিত করিয়াছে পশ্চিমবঙ্গ। যাঁহার দেহে কলিকাতায় প্রথম কোভিড সংক্রান্ত প্যাথলজিক্যাল অটোপ্সি হইল, সেই ব্রজ রায় ও তাঁহার সংগঠন ‘গণদর্পণ’-এর হাত ধরিয়া মরণোত্তর দেহদানে পথিকৃৎ হইয়াছিল পশ্চিমবঙ্গ। পরবর্তী কালে অঙ্গদানের প্রক্রিয়া সহজতর করিবার জন্য বিভিন্ন রাজ্যে আইন প্রণীত হইয়াছে, যথাযথ ভাবে তাহার প্রয়োগ করিয়া এই কাজে শীর্ষস্থান দখল করিয়াছে তামিলনাড়ু, কিন্তু বঙ্গজনের অগ্রদূতের ভূমিকা উপেক্ষা করিবার নহে। এমন এক ঐতিহ্য সৃষ্টি করিতে না পারিলে বিভিন্ন রাজ্যে বা কেন্দ্রে আইন প্রণীত হইত কি? রাষ্ট্রীয় সংস্কারের ভিত্তি রচনা করে নিরন্তর গণ-আন্দোলন ও কতিপয় ব্যক্তির সাহসী পদক্ষেপ।
‘পূর্ব ও পশ্চিম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন, আধুনিক ভারতে যাঁহাদের মধ্যে মানবের মহত্ত্ব প্রকাশ পাইবে, যাঁহারা নবযুগ প্রবর্তন করিবেন, তাঁহাদের প্রকৃতিতে একটি স্বাভাবিক ঔদার্য থাকিবে। সেই ঔদার্যের প্রকাশ মধুসূদন গুপ্ত হইতে ব্রজ রায়ে বহমান। তাই তাঁহারা দেশকে পথ দেখাইতে পারিয়াছেন। প্রশ্নটি শেষাবধি মানসিকতারই। ২০১৭ সালের হিসাব বলিতেছে, সেই বৎসর দশ লক্ষ দেহদানের অঙ্গীকারের মধ্যে মাত্র ১৮০০ সম্পন্ন হইয়াছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দাতার পরিবারের প্রবল আপত্তিতে দান করা দেহ মেডিক্যাল কলেজের পরিবর্তে শ্মশানযাত্রা করিয়াছিল। এই ব্যর্থতার পশ্চাতে কখনও দায়ী দেহ গ্রহণে সরকারি লাল ফিতার ফাঁসও। চিকিৎসা-বিজ্ঞানে দেহদানের গুরুত্ব অপরিসীম; অতএব সমাজে বিজ্ঞানমনস্কতার বিকাশ ঘটাইয়া দেহদানে উৎসাহ সৃষ্টি যতখানি জরুরি, উহার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণও ততখানিই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ-সংস্কার আন্দোলন প্রশাসনিক অদক্ষতার অন্ধগলিতে হারাইয়া যাওয়া অতি দুর্ভাগ্যের। দুইটি মিলিয়াই অগ্রগতি সম্ভব। সেই অগ্রগতির পথ সুগম করে প্রকৃত রাজনীতি।