একটি সামাজিক বিপ্লবের অভিমুখে নীরবে একটি পদক্ষেপ করিল বাংলাদেশ। সরকার ঘোষণা করিয়াছে, কোনও বেসরকারি সংস্থা যদি তাহার মোট কর্মিবর্গের একটি ন্যূনতম অংশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, লিঙ্গান্তরিত এবং রূপান্তরকামী মানুষকে নিয়োগ করে, তবে সেই সংস্থাকে বিশেষ কর ছাড় দেওয়া হইবে। পদক্ষেপটি জরুরি— পুরুষ-নারী বিভাজিত সমাজে লিঙ্গ পরিচিতির কারণেই অসাম্যের শিকার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ; চাকুরিক্ষেত্রেও তাঁহারা বঞ্চিত। এই অনুন্নয়নের পশ্চাতে সামাজিক কুসংস্কার আছে, তাঁহাদের চাকরি না দিবার পশ্চাৎপদ সংস্কৃতি আছে, এমনকি দীর্ঘ দিন পিছনে ঠেলিবার কারণে যোগ্য প্রার্থীর অভাবও আছে, কিন্তু কোনও যুক্তি নাই। যোগ্যতাও বহুলাংশে সামাজিক নির্মাণ, কাহাকেও গ্রহণ না করিবার প্রচলন যোগ্য হইয়া উঠিবার পথের অন্তরায়। অতএব, রূপান্তরকামী মানুষদের চাকুরিতে লইলে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক কর ছাড়ের ঘোষণা বণ্টনের ন্যায্যতা নির্মাণেরই প্রয়াস। সব ধারার মানুষকে সামাজিক ন্যায়বিচার দিবার দায়িত্বটি রাষ্ট্র পালন করিতেছে, তাহা প্রশংসার্হ।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য সুযোগের সাম্য সৃষ্টির পথটি সহজ নহে। তাহা সংরক্ষণের ন্যায় গণ্ডি বাঁধিয়া দিবার উপায় হউক, কিংবা আর্থিক উৎসাহদানের ন্যায় বাজার অর্থনীতির প্রক্রিয়া হউক, প্রশ্নটি কেবল কোনও গোষ্ঠীকে উন্নীত করিবার বা সুবিধা দিবার নহে, তাঁহাদের ‘বৈধ’ নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি দিবারও বটে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র তাঁহাদের জন্য কোনও সুযোগের ব্যবস্থা করিলে তাহা শুধুমাত্র উন্নয়নের আয়ুধই নহে, এই জনগোষ্ঠীর পক্ষে একটি রাজনৈতিক বক্তব্যও বটে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য যদি চাকুরিক্ষেত্রের পরিসরটিকে খুলিয়া দেওয়া যায়, তবে তাঁহাদের প্রতি সমাজের গ্রহিষ্ণুতা বাড়িবে বলিয়াই আশা। কর্মক্ষেত্রে পার্শ্বের কুর্সিতে কোনও মহিলাকে দেখিলে কোনও পুরুষ আজ যেমন আর বিস্মিত হন না— মাত্র কয়েক দশকেই সমাজ এই পরিবর্তন সাধন করিতে পারিয়াছে— তৃতীয় লিঙ্গের ক্ষেত্রেও তাহা সম্ভব। পরিবর্তনের এই মন্ত্রটি সমাজের ভিতর হইতে উচ্চারিত হইলেই তাহা সর্বাপেক্ষা কাম্য হইত। কিন্তু সমাজকে পথ প্রদর্শন করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব বইকি। বাংলাদেশে সরকার সেই দায়িত্ব স্বীকার করিয়াছে।
এই সূত্রে সমকামিতা ‘সারাইবার’ বিরুদ্ধে মাদ্রাজ হাই কোর্টের সাম্প্রতিক রায়টি পড়িতে হয়। আদালত জানাইয়াছে, চিকিৎসকের সহায়তায় সমকামী ব্যক্তিকে ‘সুস্থ’ করিয়া তুলিবার উদ্যোগ অপরাধমূলক। তাঁহারা আর সকলের ন্যায় স্বাভাবিক। সচেতনতা তৈরি করিয়া, আইন প্রণয়ন করিয়া তাঁহাদের মূলধারায় লইয়া আসা জরুরি। ইহার অর্থ, সমকামীদের যে বৈশিষ্ট্য মূলধারায় খাপ খায় না, তাহার পরিচিতি ঘটানো ও তাহা সম্পর্কে সচেতন করা। যে কোনও ‘অপর’ সম্পর্কেই সমাজের অস্বস্তি থাকে, সমাজকে তাহা গ্রহণ করাইবার প্রক্রিয়া লইতে হয়। এই ক্ষেত্রেও ‘অপর’ যৌনতার মানুষকে ‘স্বাভাবিক’ বলিয়া স্বীকারের প্রক্রিয়াতেই তাঁহারা মূলধারায় প্রবেশ করিতে পারিবেন। উহাই স্বীকৃতি; স্বীকারোক্তিও বটে। বঞ্চিতের স্বীকৃতি পাইবার অর্থ বঞ্চনার অন্যায় স্বীকার করিয়া লওয়াও। বস্তুত, দুইটি শব্দের উৎসই ‘স্বীকার’। কাহারও নিকট তাহা সম্মতি, কাহারও নিকট একরারনামা।