সপ্তাহান্তের রাতে যে আগুন লেগেছে, দু’দিন পেরিয়েও সম্পূর্ণ নির্বাপিত হয়নি তা। দাউদাউ আগুন জ্বলেছে, বিস্ফোরণ ঘটেছে একের পর এক কন্টেনারে, চিৎকার আর্তনাদ দৌড়াদৌড়ির মধ্যে এক দিকে আগুন নেবানো, ঠিক তার পাশেই চলেছে উদ্ধারকাজ— পুড়ে ঝলসে যাওয়া মৃতদেহদের বার করে আনা, দেহাংশ উড়ে যাওয়া মারাত্মক আহত মানুষগুলিকেও। বাংলাদেশে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বেসরকারি কন্টেনার গুদামে দুর্ঘটনা এমনই মর্মান্তিক, বলা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর এমন বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড কোনও কন্টেনার গুদামে ঘটেনি। সরকারি হিসাবে মৃত চল্লিশেরও বেশি, আহত কয়েকশো, বিস্ফোরণের জেরে আশপাশের পাঁচ কিলোমিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত; কিছু কন্টেনারে সঞ্চিত হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড তথা রাসায়নিকের জেরেই যে হেতু বিস্ফোরণ, তাই কথা উঠেছে নিকটবর্তী জলাভূমি ও সমুদ্রের জলে রাসায়নিক মেশার আশঙ্কা নিয়েও। প্রাণহানি, অমূল্য মানবসম্পদের ক্ষয় ও তেরোশো কোটিরও বেশি বাংলাদেশি অর্থমূল্যের ব্যবসায়িক ক্ষতির অভিঘাতে স্তব্ধ দেশ।
দুর্ঘটনার কারণ ও তার পিছনের গাফিলতি ঘিরে কিছু প্রশ্ন তবু প্রকট। বেসরকারি কন্টেনার গুদামটি প্রয়োজনীয় অনুমোদন ছাড়াই চলছিল বলে অভিযোগ উঠেছে, কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করে কাগজপত্র দেখিয়েছেন। তবে তা কত দূর সত্য তা নিয়েও সংশয়, কারণ পাঁচ বছর আগেও নিরাপত্তা ও যন্ত্রপাতির শর্ত পূরণ না করার জন্য এই গুদামের লাইসেন্স নবীকরণ বন্ধ রাখা হয়েছিল। মাঝে দু’বছরেরও বেশি সময় কেটেছে অতিমারিতে, তার পর জীবন ও কাজ ক্রমে স্বাভাবিক হলেও বিশালায়তন গুদামটির অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা-সহ সার্বিক নিরাপত্তার বন্দোবস্ত যে নিখুঁত ছিল না, দুর্ঘটনার ব্যাপ্তি ও গভীরতাই কি তার প্রমাণ নয়? একই গুদামে কন্টেনারে এবং তার বাইরে টিনের শেডের নীচে রাসায়নিক রাখা হচ্ছে, আবার রফতানিযোগ্য পোশাকও— এ কি অব্যবস্থা নয়? রাসায়নিক পদার্থ অনেকাংশে বিপজ্জনক, তা নিয়ম মেনে বৈধ ব্যবস্থায় মজুত করা হয়েছিল কি না, এই ধরনের জিনিস মজুত করতে যে প্রস্তুতি লাগে গুদামে তা ছিল কি না, প্রশ্ন অনেক। রাসায়নিক-ঘটিত আগুন নেবানোর কৌশলও আলাদা, অথচ দমকলকর্মীরা কাজ শুরু করেন প্রচলিত পদ্ধতিতে জল দিয়ে, অর্থাৎ আগুনের চরিত্র সম্পর্কে গোড়ায় তাঁরা ছিলেন অন্ধকারে। বহু শ্রমিক, ট্রাকচালক ও অন্যান্য কর্মী অগ্নিদগ্ধ ও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেলেন, দমকলকর্মীদের কাজের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের তৎপরতা ও পেশাদারিত্ব যুক্ত হলে কিছু প্রাণ হয়তো বা বাঁচত।
দায়িত্ব এড়াতে পারে না সরকারও। কারণ বেসরকারি এই কন্টেনার গুদাম চলছিল চট্টগ্রাম বন্দরের সহযোগী হিসাবে, তার পরিচালন ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় তদারকির দায়িত্ব যথাক্রমে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও নৌ-পরিবহণ দফতরের। এখন দুর্ঘটনার পর সব আঙুল উঠছে বেসরকারি সংস্থার দিকে, তদন্ত কমিটি গড়া হয়েছে, জরিমানা শাস্তি সবই হবে। কিন্তু যে বেসরকারি গুদামের কার্যক্রমের সঙ্গে দেশ ও দশের মান প্রাণ ও বৈদেশিক মুদ্রার জোগান জড়িয়ে, তাকে যে সতত চোখে চোখে রাখতে হয়, সেই সহজ অথচ জরুরি সত্যটি প্রশাসন ভুলল কী করে? হতাহতদের পরিবারের হাতে অর্থ তুলে দিয়ে এই ক্ষতি পূরণ হবে কি?
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।