—প্রতীকী চিত্র।
সৎ সাংবাদিকতার প্রতি বর্তমান শাসকদের বিরাগ, আক্রোশ এবং প্রতিশোধস্পৃহার কথা শুধু ভারত কেন, গোটা দুনিয়াই জানে। তবুও, নিউজ় ক্লিক নামক অনলাইন সংবাদ সংস্থার সঙ্গে সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটল, তা নরেন্দ্র মোদীর জমানার মাপকাঠিতেও ভয়াবহ। সংস্থাটির সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ এবং এক সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হল চিনের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে। প্রয়োগ করা হল ইউএপিএ নামক দানবিক আইনটি। তার আগে বিপুল তল্লাশি চালানো হল সংস্থার দফতরে, সাংবাদিকদের বাড়িতে; বাজেয়াপ্ত করা হল মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ। ঠিক কোন সংবাদ প্রতিবেদনটি নিয়ে অভিযোগ, তদন্তকারী সংস্থা জানায়নি। যে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে এই বিপুল তল্লাশি ও গ্রেফতার, তার সম্বন্ধেও বিন্দুবিসর্গ জানা যায়নি। নিউজ়ক্লিক-এর তরফে জানানো হয়েছে যে, এফআইআর-এর প্রতিলিপিও তাদের দেওয়া হয়নি। শোনা গিয়েছিল, আমেরিকার সংবাদপত্র নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদনে থাকা একটি সংশয় থেকেই নাকি এই বিপুল তৎপরতার সূত্রপাত। উল্লেখ্য যে, সেই প্রতিবেদনেও কোনও নির্দিষ্ট সংবাদের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করা হয়নি। একটি বিদেশি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটিমাত্র সংবাদ প্রতিবেদনের একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতকে নরেন্দ্র মোদীর সরকার এত গুরুত্ব দেবে কেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে জানা গেল যে, নিউজ়ক্লিক-এর বিরুদ্ধে তদন্তে প্রক্রিয়াটি সেই প্রতিবেদন প্রকাশের আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। তিলমাত্র সন্দেহের কারণ নেই যে, সমগ্র ঘটনাটি এক প্রবল প্রতিহিংসার প্রকাশমাত্র। এবং, এ বিষয়ে যাতে সংশয়ের কিছুমাত্র অবকাশ না থাকে, সরকার তা নিশ্চিত করেছে।
নিউজ়ক্লিক ও তার সম্পাদক বেশ কিছু দিন ধরেই রাজরোষে পড়েছেন। ২০২১ সাল থেকেই তাঁরা ইডি ও আয়কর দফতরের নজরদারিতে রয়েছেন। তখনও সংস্থার ল্যাপটপ ফোন ইত্যাদি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। দিল্লি হাই কোর্ট সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে গ্রেফতার করার বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তবে শুধু প্রবীর নন, বিভিন্ন সরকারি তদন্তকারী সংস্থার হয়রানির শিকার হয়েছেন আরও বহু সাংবাদিক ও সংবাদসংস্থা। ছকটি পরিষ্কার— যে সাংবাদিকই কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যায়ের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন, তাঁকেই হয়রানির মুখে পড়তে হয়েছে। যে সংবাদপত্র সরকারের সমালোচনা করেছে, সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়েছে তার জন্য; তেমন প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন মামলার জালে জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। অবশ্য, কেউ বলতে পারেন যে, শুধু সরকার বা প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করলেই রাজরোষে পড়তে হয়, তা নয়— প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ কোনও শিল্পপতির বিষয়ে বেশি লেখালিখি করলেও যে বিপদ ঘটে, তার হাতেগরম প্রমাণ রয়েছে। গত দশ বছরে বুঝিয়ে দেওয়া গিয়েছে যে, ব্যক্তি-নাগরিক বা সাংবাদিক, সরকারের সমালোচনা করলে কারও রেহাই নেই।
কথাটি বুঝতে যাতে কারও কোনও অসুবিধা না থাকে, তা নিশ্চিত করতেই কি নিউজ়ক্লিক-এর ঘটনাক্রমকে এমন প্রকট ভাবে প্রতিহিংসামূলক করে তোলা হল? যাতে বোঝা যায় যে, গণতন্ত্র, দেশের আইন বা সংবিধান, বর্তমান শাসকরা কিছুরই তোয়াক্কা করেন না? প্রতিবাদী স্বরমাত্রেই তাঁদের কাছে শত্রু, এবং তাঁরা সর্বশক্তিতে সেই প্রতিবাদী স্বরকে দমন করবেন? কেউ বলতেই পারেন যে, দেশে ফের জরুরি অবস্থা ঘোষিত হল। ১৯৭৫ সালের জুন মাসের সঙ্গে ফারাক— এ বার আর ‘জরুরি অবস্থা’ কথাটি আলাদা করে উচ্চারণ করতে হয়নি। উচ্চারণ না করেই দেশের সব সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে জানিয়ে দেওয়া গিয়েছে যে, স্বেচ্ছায় আত্মনিয়ন্ত্রণই বাঁচার একমাত্র পথ। আশা করা যায়, ভারতীয় নাগরিকরা বুঝতে পারছেন যে, ৩ অক্টোবরের আক্রমণ কোনও নির্দিষ্ট সংবাদসংস্থার বিরুদ্ধে নয়, তা দেশের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে এক সামূহিক আক্রমণ।