Attack on Media

সাংবাদিকের বিরুদ্ধে

সাংবাদিকের উপর এই আক্রমণ বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নিরাপত্তা দেওয়া দূরে থাক, সাংবাদিকের উপরেই মানসিক ও শারীরিক নিগ্রহ, ভীতিপ্রদর্শন করছে পুলিশ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৪৫
Share:

বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু দর্শন হয়: বর্তমান ভারতের প্রতিফলন সাংবাদিক-হিংসার মধ্যেই। রাজধানী দিল্লিতে ‘হিন্দু মহাপঞ্চায়েত’ সম্মেলনে সংবাদ-সংগ্রহরত তিন মুসলিম সাংবাদিককে ‘জেহাদি’ বলে আক্রমণ করল হিন্দুত্ববাদীরা। পরিচয়পত্র দেখানো সত্ত্বেও নিষ্কৃতি মেলেনি, কারণ তাঁরা মুসলিম। পর দিন আক্রান্ত সাংবাদিকদের এক জনের বিরুদ্ধেই এফআইআর দায়ের করল পুলিশ। তাঁর দোষ, তিনি মুসলিম-বিদ্বেষীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ সমাজমাধ্যমে প্রচার করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছেন। একই কারণে তাঁর সংবাদ-সংস্থার বিরুদ্ধেও মামলা করেছে পুলিশ। অস্বাভাবিক এই ঘটনা মনে করিয়ে দেয়— সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের প্রতি রাষ্ট্রের আক্রোশকে। হাথরসে গণধর্ষণের খবর করতে যাওয়ার পথে যাঁকে গ্রেফতার করা হয় ‘সন্ত্রাসবাদী’ হওয়ার অভিযোগে। সেই ঘটনাতেও অভিযোগ উঠেছিল, কাপ্পানের ধর্মীয় পরিচিতিই তাঁকে পুলিশের চোখে ‘সন্দেহভাজন’ করে তুলেছে, দিল্লিতে দীর্ঘ দিন সাংবাদিকতা করা সত্ত্বেও সাংবাদিকের প্রাপ্য সুরক্ষা তাঁকে দেয়নি পুলিশ-প্রশাসন। ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতায় যার শুরু, সেই ভ্রান্তির চূড়ান্ত প্রকাশ সত্যের প্রতি অসহিষ্ণুতায়। দিল্লির ঘটনার দু’দিনের মধ্যে ভোপালের একটি থানায় বিক্ষোভের চিত্রগ্রহণরত এক সাংবাদিককে গ্রেফতার করে পুলিশ। অভিযোগ, তিনি বিজেপি বিধায়কের বিরুদ্ধে খবর করেছেন। শারীরিক নিগ্রহ এবং একাধিক গুরুতর ধারায় মামলা দিয়েই পুলিশ ক্ষান্ত হয়নি, ওই সাংবাদিকের জামাকাপড় খুলিয়ে কেবল অন্তর্বাস পরা অবস্থায় তাঁর ভিডিয়ো তুলে তা সমাজমাধ্যমে প্রচার করেছে। বিক্ষোভকারীদের উপর পুলিশি অত্যাচারের সংবাদ প্রকাশ করলে নগ্ন করে শহর ঘোরানোর হুমকিও দিয়েছে। সংবাদের স্বাধীনতার সূচকে যার স্থান এখন একশো আশিটি দেশের মধ্যে একশো বিয়াল্লিশতম, তাতে আশ্চর্য কী?

Advertisement

সাংবাদিকের উপর এই আক্রমণ অবশ্যই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বার বার দেখা যাচ্ছে, নিরাপত্তা দেওয়া দূরে থাক, সাংবাদিকের উপরেই মানসিক ও শারীরিক নিগ্রহ, ভীতিপ্রদর্শন করছে পুলিশ। নানা মিথ্যা অভিযোগে মামলা করছে পুলিশ, প্রশাসনিক কর্তা কিংবা মন্ত্রীরা। এই সব মামলার প্রধান উদ্দেশ্য সাংবাদিকের অপরাধের প্রতিষ্ঠা বা শাস্তিবিধান নয়, সাংবাদিকের অর্থ ও সময় নষ্ট করে তাঁকে হয়রান করা। গৌরী লঙ্কেশ নিহত হওয়ার আগে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন মামলার জেরে। এ ছাড়াও সমাজমাধ্যমে অনবরত হুমকি চলে, যার প্রধান লক্ষ্য মহিলা সাংবাদিকরা। ২০১৭ সালে সমীক্ষায় প্রকাশ, মাত্র এক সপ্তাহে বিজেপির তীব্র সমালোচক, সাংবাদিক রানা আইয়ুব আড়াই হাজারেরও বেশি হিংসাত্মক টুইট বার্তা পেয়েছেন। এই সমাজমাধ্যমের ‘ট্রোল’-রা সরকারি ক্ষমতাসীনদের আশ্রিত, তাঁদের দ্বারা পোষিত।

ফের তারই ইঙ্গিত মিলল, যখন রানা আয়ুবের বিদেশযাত্রার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। রানা একটি আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতে সাংবাদিকতার পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। দিল্লি হাই কোর্টে অবশ্য ইডি-র নিষেধাজ্ঞা খারিজ হয়ে গিয়েছে, তবু ‘লুক আউট’ নোটিস জারি করে সাংবাদিকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের এই নিদর্শন বিশ্বের কাছে ভারতের সাংবাদিকতার প্রকৃত রূপটি প্রকাশ করল। কাশ্মীর থেকে ছত্তীসগঢ়, সত্যসন্ধানী সাংবাদিকের উপর আক্রমণ, সাংবাদিক হত্যা বলে দেয়, রাষ্ট্রই সংবাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করছে। কখনও পুলিশ, কখনও ইডি, কখনও আয়কর বিভাগকে কাজে লাগানো হচ্ছে। এ দেশেরই এক সন্তান ১৮২৩ সালে শাসককে লিখেছিলেন, যে সুশাসন চায় সে সংবাদ প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা অবশ্যই চাইবে। দু’শো বছর পেরিয়েও রামমোহন রায়ের সেই কথার সম্মান রাখেনি দেশ।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement