ভারতে পথ-নিরাপত্তা আইন এবং পথ-দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বিষয়ক সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ব্যবহার করায় ২০২২ সালে প্রাণহানি হয়েছিল ১,১৩২ জনের। ওই একই বছরে সিগন্যাল ভেঙে যাতায়াতের জন্য মৃত্যু হয় ২৭১ জনের। অর্থাৎ, দ্বিতীয়টির তুলনায় প্রথম কারণটিতে মৃত্যুর হার ৪.১ গুণ বেশি। এ তো গেল পরিসংখ্যানের কথা। ভুক্তভোগীমাত্রেই জানেন, এর বাইরেও গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ব্যবহারের কারণে এক বড় সংখ্যক দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে, যা সর্বদা এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না হয়তো বা কারও প্রাণহানি হয় না বলে। কিন্তু তাতেও যে অসংখ্য মানুষ গুরুতর জখম হন, অঙ্গহানি ঘটে পরিবারিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ান, সেগুলিকে একত্র করলে মোবাইলের ব্যবহারজনিত বিপদের ভয়ঙ্কর চিত্রটি স্পষ্ট হয়। আশ্চর্যের বিষয়, এ দেশে পথ-নিরাপত্তা সংক্রান্ত সুস্পষ্ট, কঠোর আইন আছে। যদিও বাস্তব বলে, সেই আইন নানাবিধ ‘চাপ’-এ হামেশাই অকেজো থেকে যায়।
শুধুমাত্র মোবাইল ব্যবহারই নয়, গবেষণায় আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকও উঠে এসেছে। যেমন— ২০২২ সালে জাতীয় সড়কগুলিতে পথ-দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটেছিল ৬১,০৩৮ জনের। এর ৭৫ শতাংশের জন্যই দায়ী মাত্রাতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো। ভুল দিক দিয়ে, মদ খেয়ে গাড়ি চালানো বা গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ব্যবহারের কারণে প্রাণহানির হার মোট মৃত্যুর প্রায় ১০ শতাংশ। অথচ কঠোর আইন প্রয়োগে এগুলি প্রতিরোধ করা অ-সম্ভব ছিল না। তাতে প্রাণহানি সম্পূর্ণ রোধ করা না গেলেও সংখ্যায় নিয়ন্ত্রণ আনা যেত। কিন্তু তা হয়নি। যেমন— দেশে হেলমেটহীন অবস্থায় দ্বিচক্রযানে যাত্রার সুনির্দিষ্ট শাস্তি রয়েছে। অথচ, ২০২২ সালে দ্বিচক্রযান দুর্ঘটনায় প্রায় ৫০,০০০ হেলমেটহীন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এ-হেন দুর্ঘটনাগুলির অন্যতম কারণ— এ দেশে আইন প্রয়োগের সদিচ্ছাটিও কাঞ্চনমূল্যে বিক্রি হয়। তদুপরি, রাজনীতি, ক্ষমতা, সামাজিক অবস্থান প্রভৃতি ধাপ পেরিয়ে আইনকে নিজ কর্তব্য করতে হয় বলে শেষ পর্যন্ত তার কঠোর ধারাগুলিও লঘুতর হতে থাকে।
তবে, আইন প্রয়োগের পাশাপাশি মানুষের নিজ দায়িত্ববোধেরও জাগরণ হওয়া একান্ত আবশ্যক। দায়িত্ব নিজের প্রতি, দায়িত্ব সহ-নাগরিক হিসাবে অন্যদের প্রতি। কিন্তু, সে দায়িত্ব ভুলে থাকাই যেন এক প্রকার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন— পথেঘাটে মোবাইল ব্যবহারের বিপদ এবং তার পরিণতিতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা সম্পর্কে নাগরিক যথেষ্ট সচেতন। তবুও চালকের আসনে বসে, অথবা রাস্তা পার হওয়ার সময় মোবাইলের ব্যবহারে কমতি নেই। প্রাণের প্রশ্নে যে কোনও রকম বিচ্যুতি, কোনও অজুহাতের জায়গা নেই, এ কথাটি নাগরিক, আইনরক্ষক কারও মনে থাকে না। ফলে আহত-নিহতের সংখ্যা ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী হয়। মনে রাখতে হবে— এই বিশাল জনসংখ্যার দেশে শুধুমাত্র কঠোর আইন প্রয়োগই যথেষ্ট নয়। আইন এবং নাগরিকের দায়িত্বজ্ঞান— উভয়কেই উভয়ের পরিপূরক হিসাবে কাজ করতে হবে। ভারতের জনবহুল শহরগুলিতে পথ-নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা সহজ কাজ নয়। এ কাজ সহজ এবং সফল করতে প্রশাসন এবং নাগরিক— উভয়েরই সদিচ্ছা অত্যাবশ্যক।