সুখের দুই শত্রু হল যন্ত্রণা আর একঘেয়েমি, লিখেছিলেন এক জার্মান দার্শনিক। জীবনযন্ত্রণার চটজলদি উপশম মানুষের এখনও করায়ত্ত নয়, তবে দ্বিতীয়টির দাওয়াই
হিসাবে সে একুশ শতকে বরণ করেছে সমাজমাধ্যমকে। এতটাই যে, রাস্তাঘাটে বাসে-ট্রামে চলতে গিয়ে সহযাত্রীর মুুখের দিকে তাকিয়ে দেখার ফুরসতটুকুও সে সঁপে দিয়েছে স্মার্টফোনকে, সমাজমাধ্যমে অবিরল ‘রিল’ বা ‘শর্টস’ ভিডিয়ো-ধারায়। এই সব ভিডিয়োর উপজীব্য হাস্যকরই হোক কি গুরুতর, তাতে প্ররোচনা বা প্রণোদনা যা-ই লুকিয়ে থাকুক, বিপুলসংখ্যক মানুষ অবসরে বা কাজের মাঝেই সমাজমাধ্যমে একের পর এক ভিডিয়ো দেখে চলেন। কেন এগুলি দেখা প্রয়োজন, জিজ্ঞাসা করলে নানাবিধ উত্তর আসে: ভাল লাগে তাই দেখি; সময় তো কাটাতে হবে; নয়তো কী করব— ইত্যাদি। বই সকলের প্রিয় নয়, শিল্পচর্চা সকলকে টানে না, এমনকি খেলা বা সিনেমাও আজ অবধারিত বিনোদনের মুকুটটি খুইয়েছে। অথচ প্রতিটি মানুষের মনের গভীরে আছে একঘেয়েমির ভয় যা তাকে ক্রমাগত বলে চলে জীবনে বৈচিত্র নিয়ে আসার কথা, নইলে এই সময় ও এই জীবন তাকে গ্রাস করবে অতল বিষাদে। সেই জন্যই ফোনের ওই ছোট্ট স্ক্রিনটি হয়ে উঠেছে মুশকিল আসান, আঙুলের ক্রমাগত সঞ্চরণে অন্য জীবনে, অন্য ও ভিন্ন এক বাস্তবতায় ঢোকা বা বেরোনো যায় অনায়াসে।
কিন্তু যার জন্য এত কিছু, সেই একঘেয়েমি কি সত্যিই কাটে ছোট-বড় এই ভিডিয়োগুলি দেখে? সমাজমাধ্যমের অতিব্যবহার, মানবমন ও মনোযোগ ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা চলছে অনেক দিনই। এ বার কানাডার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা জানাল, সমাজমাধ্যমে যাঁরা মুহুর্মুহু এক ভিডিয়ো থেকে অন্য ভিডিয়োয় সরে সরে যান, কিংবা একটি ভিডিয়ো দেখার সময়ও তাকে আঙুল দিয়ে আগে-পিছে টেনে আকর্ষক জায়গাটি খুঁজে চলেন, তাঁদের একঘেয়েমি তো কাটেই না, বরং বেড়ে যায়। গবেষক-দল নানা সমীক্ষার মাধ্যমে, ভিডিয়ো-‘দর্শক’দের বয়স, রিলের সময়সীমা ইত্যাদির তারতম্য ঘটিয়ে দেখেছেন— যে একঘেয়েমি থেকে বাঁচতে এত কিছু, তা বেড়ে চলে দর্শক একটি তথাকথিত দীর্ঘ ভিডিয়োর মধ্যে সময়রেখা আগুপিছু করে সারবস্তু খুঁজে চলার সময়, ক্রমাগত ‘সোয়াইপ’ করে অন্য একাধিক ভিডিয়োয় সরে যাওয়ার সময়ও। কারও কাছে একটি ভিডিয়ো দেখতে গিয়ে একঘেয়ে লাগছে বলে তিনি অন্য ভিডিয়োয় সরে যাচ্ছেন, সেখানেও সুখ হচ্ছে না বলে অন্য একটিতে, এ ভাবেই আরও। এই আবর্তন ও পুনরাবর্তনে সময় কাটছে, একঘেয়েমি কাটছে না।
প্রযুক্তিসর্বস্ব সময়ের নিহিত ট্র্যাজেডি এটাই: যা থেকে পালাতে চাওয়া তাতেই আরও জড়িয়ে পড়া; পালাতে চেয়ে যার সাহায্য নেওয়া, তার সুবাদেই আরও বন্দি হয়ে পড়া। আমরা আসলে মনপ্রাণ দিয়ে সময়ের সঙ্গে যতটা অন্বিত বা ‘এনগেজড’ হতে চাই, যে ভাবে চাই, কার্যকালে ততটা এবং সে ভাবে অন্বিত হতে পারি না। তখনই আমাদের গ্রাস করে একঘেয়েমি। গবেষকরা বলছেন, একুশ শতকের মানুষ তার পূর্বসূরিদের তুলনায় চরিত্র ও আচরণগত ভাবে বেশি একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে কারণ তার মধ্যে কোনও অভিজ্ঞতায় নিজেকে মগ্ন রাখার সামর্থ্য ও ধৈর্য নেই। সে ডুবতে পারে না, শুধুই ভেসে থাকতে পারে। যে সমাজমাধ্যমে সে প্রাণপণ বৈচিত্র খুঁজছে, তা-ই হয়ে উঠছে তার সর্বস্ব ও সর্বনাশ।