মায়ানমারের গৃহযুদ্ধ চিন্তা বাড়াচ্ছে দিল্লির। —ফাইল চিত্র।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই আর এক পড়শি মায়ানমারের গৃহযুদ্ধ চিন্তা বাড়াচ্ছে দিল্লির। সম্প্রতি মায়ানমারের সামরিক বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’-এর অন্যতম বড় দল আরাকান আর্মি (এএ) রাখাইন প্রদেশে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তীব্র লড়াইয়ের পরে দখল করে নিয়েছে সেনার গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমের ঘাঁটি। এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটার লম্বা সীমান্তবর্তী এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে এল বিদ্রোহীদের হাতে। দেশের মুসলমান সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন অঞ্চলে দু’তরফে তীব্র লড়াই শুরু হয় গত নভেম্বরে, সামরিক বাহিনী এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পরে। অভিযোগ, যুদ্ধের মাঝে বিদ্রোহীদের নিশানায় পড়তে হয়েছে এই অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের, যার জেরে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ পুনরায় বাড়ছে বাংলাদেশে। উল্লেখ্য, ২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতে মায়ানমারের সামরিক বাহিনী আউং সান সু চি-র নেতৃত্বাধীন সরকারকে উচ্ছেদ করার পরই সে দেশের রাজনৈতিক গোলযোগ তীব্র আকার ধারণ করে, যা শেষ পর্যন্ত পর্যবসিত হয় গৃহযুদ্ধে।
আশঙ্কার বিষয়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির সীমান্তবর্তী বহু অঞ্চলই এখন বিদ্রোহীদের দখলে। ফলে নিজ স্বার্থেই মায়ানমার পরিস্থিতির উপরে নজর রাখতে হচ্ছে দিল্লিকে। পড়শি রাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের আঁচ শুধু আগে নয়, সাম্প্রতিক কালেও ছড়িয়েছে মণিপুরের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে। অশান্তির পর্বে মাদক, অস্ত্র চোরাচালানের পাশাপাশি দুই দেশের ছিদ্রময় সীমান্ত সাক্ষী থেকেছে মায়ানমারের তরফে জঙ্গি-সহ অবৈধ অনুপ্রবেশেরও। মণিপুরের অশান্তির আবহে তাই গত ফেব্রুয়ারিতেই মায়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘ ১৬৪৩ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। পাশাপাশি বাতিল হয়েছিল ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম’-ও (এফআরএম)। স্থানীয় বাণিজ্যে সহায়তার পাশাপাশি সীমান্তবর্তী অধিবাসীদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতি এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার স্বার্থে চালু হয় এফআরএম। কিন্তু পূর্বাঞ্চলে অস্থিরতার জেরে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির জনবিন্যাস সংক্রান্ত কাঠামো বজায় রাখতে সেই পদক্ষেপে দাঁড়ি টানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। মণিপুর এবং মিজ়োরামের কুকি জনজাতিদের সঙ্গে মায়ানমারের একাংশের জাতিগত সম্পর্ক রয়েছে, ফলে সীমান্ত বন্ধের জেরে ক্ষোভও জমেছে।
মায়ানমারে চিনের প্রভাব রুখতে সে দেশে একাধিক বড় প্রকল্প গড়ে তুলছে ভারত। গৃহযুদ্ধের আবহে সেগুলি এখন অনিশ্চয়তার মুখে। মায়ানমারের গৃহযুদ্ধের সঙ্গে যে গভীর ভাবে জড়িয়ে রয়েছে চিনও, দু’পক্ষের সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে তারা, দিল্লির এ কথা ভুললে চলবে না। ফলে পড়শি রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অঙ্কটিকে পুনরায় নতুন করে কষতে হবে দিল্লিকে। একই সঙ্গে দেশের বর্তমান শাসক দলকে বুঝতে হবে, ক্রমপরিবর্তনশীল ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মতো পড়শি রাষ্ট্রগুলির সাহায্যে বেজিং ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির হিন্দুত্ববাদের প্রতিক্রিয়াগন্ধী সাম্প্রদায়িক হিংসাবৃদ্ধির কাজে লাগাতে পারে। ‘বৈশ্বিক দক্ষিণ’-এর নেতা হতে গেলে ভারতকে এই চালগুলিকে প্রতিহত করতেই হবে।