—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
আর কয়েক দিন বাদে এক মাস পূর্ণ হবে, আর জি কর ঘটনার জেরে জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতির ফলে চিকিৎসার অচলাবস্থা এখনও কাটছে না। রাজ্যজোড়া ঐতিহাসিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ধরনের দৈনন্দিন কার্যকলাপই ব্যাহত হচ্ছে, হওয়ারই কথা। তবে চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়লে বা তার উপর চাপ তৈরি হলে জনজীবন যেমন ভাবে ব্যাহত হয়, অন্যান্য আর কোনও দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তার তুলনা চলে না। ক্রমশ এক সঙ্কটের চেহারা নিচ্ছে বিষয়টি। স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগম মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সম্প্রতি রিপোর্টে জানিয়েছেন, সরকারি হাসপাতালে আউটডোর পরিষেবা ও অস্ত্রোপচার কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ, এবং রোগী ভর্তির পরিমাণ কমেছে ২৫ শতাংশ। বহু সরকারি হাসপাতালের রোগী বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে পরিষেবা পাওয়ার জন্য ভিড় করছেন। বেসরকারি হাসপাতালে সেই বর্ধিত চাপের পরিমাণ সরাসরি বোঝা যাচ্ছে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের বর্ধিত খরচ থেকে। স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের আওতায় ১৫০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ মঞ্জুর করা হয়েছে বলে স্বাস্থ্যসচিবের রিপোর্ট জানাচ্ছে। এই মুহূর্তে স্বাস্থ্যসাথী খাতে সরকারের দৈনিক খরচ ৩ কোটি টাকার জায়গায় এখন ৬ কোটিতে পর্যবসিত। এই যদি হয় খরচের হিসাব, রোগীদের ভোগান্তির কোনও হিসাব বা ছবি দেওয়া অসম্ভব। অনুমান করা যেতে পারে, এই কারণে বহু সহস্র মানুষ প্রতি দিন ঘোর বিপদের মুখোমুখি হচ্ছেন, যে বিপদ থেকে বেরোনোর রাস্তা সম্পূর্ণত তাঁদের নিজেদের নাগালের বাইরে।
একই সঙ্গে লক্ষণীয়, এখনও পর্যন্ত কিন্তু এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ও বিপুল অসুবিধাবোধের ফলে কোনও বাহ্যিক অসংযম, অধৈর্য বা বিরক্তি, কিছুরই প্রকাশ দেখাননি সাধারণ মানুষ, ঠিক যে ভাবে লাগাতার আন্দোলনের চাপে মহানগরে বা অন্যান্য শহরে চলাচলের দুর্ভোগ ধৈর্য সহকারে মেনে নিচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। বুঝতে অসুবিধা নেই, সঙ্কটকালে জুনিয়র ডাক্তাররা যে অভূতপূর্ব প্রতিবাদে ইতিহাস তৈরি করছেন, তাতে সমর্থন জোগাতেই নাগরিকরা যথাসাধ্য সর্ব প্রকার সহযোগ করে চলেছেন। আর জি কর ঘটনা এমন এক ব্যথা বা আতঙ্ক তৈরি করে তুলেছে জনমনে, যার ফলে প্রতিবাদ-আন্দোলনকে ঘিরে এই বৃহত্তর সহযোগের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের এই ঐতিহাসিক ক্ষণে এই কথাটি বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। তবে তার সঙ্গে স্বভাবতই বেড়ে যায় আন্দোলনের দায়টিও। যে দায়বদ্ধতার প্রকাশ এই আন্দোলনে, তাতে মানুষের স্বার্থবিরোধী হলে তার চলবে না, এই বোধ আন্দোলনের ভিতর থেকেই জাগ্রত হওয়ার কথা।
জাগ্রত হচ্ছে কি? এক দিকে জুনিয়র ডাক্তাররা অনেকে দ্বিধাগ্রস্ত, কোনটি ঠিক পথ তাই ভেবে। সংবাদ বলছে, তাঁদের কেউ কেউ কর্মবিরতিতে দাঁড়ি টানতে চান। তাঁদের এক বড় অংশ মনে করেন, অভয়া ক্লিনিক নানা পথে-রাজপথে চিকিৎসা ছড়িয়ে দিতে পারবে। তবে কিনা, তাঁরা নিজেরাও জানেন, এ ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য, বিশেষ করে অস্ত্রোপচার বা গুরুতর অসুখের ক্ষেত্রে এ ভাবে পরিষেবা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। স্বাস্থ্যসাথীর বিষয়টিও ভাবতে হবে বইকি। অন্য দিকে, পুরসভা থেকে কিছু সরকারি হাসপাতালে রোগীদের সহায়তা করার জন্য হেল্প ডেস্ক চালু করা হলে ডাক্তারদেরই প্রবল বাধায় তা তুলে নিতে হয়েছে শেষ পর্যন্ত। রোগীদের তাঁরা নিজেরাই দেখবেন, এই দাবি শোনা গিয়েছে। দাবির সঙ্গে মানানসই পদক্ষেপও দেখা যাবে এ বার, আশা রইল। চিকিৎসা পরিষেবা সচল রাখতেই হবে, শীর্ষ আদালত আগেই তা জানিয়েছে। প্রতিবাদ-আন্দোলনের থেকে সেই কাজটি কম গুরুতর নয়। বিরোধী রাজনৈতিক মহল থেকে যে যুক্তিই ভেসে আসুক না কেন, আন্দোলনের পাশে চিকিৎসা সঙ্কট সামলাতে কর্মবিরতির বিষয়টি পুনর্বিবেচিত হওয়া জরুরি। এখনই।