রাজ্যের সব মেডিক্যাল কলেজ, তথা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির নিরাপত্তার জন্য কী কী ব্যবস্থা করবে সরকার, তার তালিকা প্রকাশিত হল। বোঝা গেল, ‘আমরা বিচার চাই’ আন্দোলন অন্তত একটা কাজ করেছে— ‘নিরাপত্তা’ বলতে কী বোঝায়, সে বিষয়ে সরকারি ধারণার পরিবর্তন এনেছে। সাম্প্রতিক তালিকায় যোগ হয়েছে কোথায় কত শয্যা খালি তার সাম্প্রতিকতম তথ্যের প্রদর্শন, রোগী রেফারের কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা শুরু করা, ডাক্তার-নার্সদের শূন্য পদে নিয়োগ, রোগী-সহ সব পক্ষের অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তি। ৯ অগস্টের ঘটনার পর-পর প্রকাশিত লালবাজার বা নবান্নের কয়েক দফা ঘোষণায় এগুলি ছিল না। মনে হতে পারে, এ সবের সঙ্গে নিরাপত্তার যোগ কোথায়? বাস্তব এটাই যে, নিরাপত্তা কেবল অপরাধের অভাব নয়। সম্মানের সঙ্গে, দেহ ও মনকে সুস্থ ও প্রসন্ন রেখে কাজ করাই হল নিরাপত্তা। নিয়ম লঙ্ঘন করে, ‘কোনও মতে’ চালিয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির মজ্জাগত, তার বিপদ এইখানেই যে, তা যে কোনও অনিয়ম, অনাচারকে মেনে নেওয়ার অভ্যাস তৈরি করে দেয়। কখন, কোথায় তা বিপদসীমা লঙ্ঘন করে যাচ্ছে, তা নিজে বোঝার এবং অন্যকে বোঝানোর উপায় থাকে না। আর জি করে তরুণী-চিকিৎসকের হত্যাকাণ্ড যে কেবল কিছু দুর্বৃত্তের আকস্মিক কুকীর্তি নয়, তা যে স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার হাড়ে-মজ্জায় প্রবিষ্ট দুর্নীতির ক্যানসারের ফল, জুনিয়র ডাক্তারদের এই দাবি কার্যত সরকার স্বীকার করল। সেই জন্যই দুই শীর্ষ স্বাস্থ্যকর্তা অপসারিত হলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই রোগী কল্যাণ সমিতি ভেঙে দিলেন, এবং নীচ থেকে উপর অবধি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের কার্যপদ্ধতিকে নিয়মে ফেরানোর ঘোষণা করতে হল। নিরাপত্তাকে সরকার বরাবরই কিছু পরিকাঠামোর ব্যবস্থায় পর্যবসিত করতে চায়। এ বার সেই সঙ্কীর্ণ ধারণা থেকে সরতে বাধ্য হয়েছে রাজ্য।
পূর্বের তালিকা থেকে কী কী বাদ গেল, সেগুলিও লক্ষণীয়। নাইট ডিউটি থেকে মেয়েদের যথাসম্ভব নিবৃত্ত করা, বা মহিলা-ডাক্তারদের কাজের সময় বারো ঘণ্টায় বেঁধে দেওয়া, হাসপাতালের মধ্যে মেয়েদের জন্য ‘সেফ জ়োন’ বা নিরাপদ বৃত্ত তৈরি করা, পূর্বের দুই তালিকায় এ সব ঘোষণা ছিল। এগুলি সরানো হয়েছে। এই অপসারণ সম্ভবত সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণের ফল— মেয়েরা বিশেষ ব্যবস্থা চায় না, তারা সমান সুযোগ চায়, বলেছেন বিচারপতিরা। কাজের পরিবেশ, রাস্তা ও পরিবহণকে ঝুঁকিপূর্ণ রেখে দিয়ে মেয়েদের বিশেষ সুরক্ষার ব্যবস্থা করার মধ্যে যে দ্বিচারিতা রয়েছে, তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে মেয়েদের ‘রাত দখল’ আন্দোলন। জনমতের এই চাপ সার্বিক নিরাপত্তার দিকে মোড় ঘোরানোয় কাজ দিয়েছে। সিসিটিভি লাগানো, বিশ্রামকক্ষ, পানীয় জল বা শৌচাগার তৈরি, মহিলাপুলিশ-সহ যথেষ্ট নিরাপত্তা রক্ষীর প্রতিশ্রুতি, যেগুলি লালবাজারের ঘোষণায় ছিল, সেগুলি রয়েছে নতুন তালিকাতেও। এত দিনে কেন এ সব ব্যবস্থা তৈরি হয়নি?
তবে নিরাপত্তার জন্য আরও একটি দাবি তুলেছেন জুনিয়র ডাক্তাররা, যা রাজ্য এড়িয়ে যাচ্ছে। তা হল, মেডিক্যাল কলেজগুলির মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ। ছাত্র সংগঠনগুলির নির্বাচন-সহ আরও যা যা ব্যবস্থা প্রয়োজন, তা তাঁরা দাবি করেছেন। এই কথাটিও গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তার বৃহৎ অর্থ যদি হয় সম্মানের সঙ্গে বাঁচা এবং কাজ করার সামর্থ্য, তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই তা সম্ভব। গণতন্ত্রের অভাব মানে স্বৈরাচার, যা সকলকে বিপন্ন করে। আর জি কর কাণ্ড দেখাল, ছাত্র, চিকিৎসক ও কর্মীদের আক্ষেপ, অভিযোগ ও দাবি ক্রমাগত অগ্রাহ্য করছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্য ভবন। প্রতিকারের চেষ্টা না করে, এক তরফা সিদ্ধান্ত সকলের উপর চাপানো হচ্ছিল। ভীতিপ্রদর্শনের সংস্কৃতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, শিক্ষক থেকে ছাত্র, সকলেই মৌন ছিলেন। তার জেরেই এই জঘন্য অপরাধ ঘটতে পারল। নিরাপত্তা চাইলে প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের পথও খুঁজতে হবে।