রাজ্যে কর্মসংস্থান বাড়াইতে বেশ কিছু বৎসর ধরিয়াই কারিগরি শিক্ষার উপরে জোর দিতেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। প্রশাসনের তরফে প্রতিশ্রুতিও মিলিয়াছিল যে, প্রশিক্ষণের পরে চাকুরির ব্যবস্থা হইবে। কিন্তু উদ্যোগ ও প্রতিশ্রুতির অনুপাতে আশানুরূপ ফল মিলে নাই। সমস্যা নানাবিধ। প্রথমত, গত দেড় বৎসর অতিমারির তাণ্ডবে চাকুরির সম্ভাবনা বিনষ্ট হইয়াছে। তাহা ভিন্ন, আইটিআই, পলিটেকনিক বা ভোকেশনাল প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলিতে সময়োপযোগী পাঠ্যক্রমের অভাব, বহু প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকদের সমস্যা, আর্থিক এবং সরকারি নিয়মবিধির কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষানবিশির ক্ষেত্রে নানান প্রতিকূলতা, সর্বোপরি শিল্পের অভাব— এই কারণগুলি কর্মসংস্থানের পথে বাধা সৃষ্টি করিয়াছে। তদুপরি আছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মানসিকতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি থাকিলেই চাকুরির বাজারে অগ্রাধিকার মিলিতে পারে— এমন ধারণাই অধিকাংশ অভিভাবকের মধ্যে বিদ্যমান। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষ কর্মীর চাহিদা শিল্পমহলে থাকেই। অনুমান করা চলে, সেই কারণেই রাজ্য সরকার হাল ছাড়িতে নারাজ। এই দফায় শিল্পসংস্থাগুলির চাহিদা বুঝিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার পরিকল্পনা করা হইতেছে।
দক্ষ কর্মী গড়িয়া তুলিবার ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বে জার্মানি দৃষ্টান্তস্বরূপ। ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাঙ্কের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে দেশগুলিতে অল্পবয়সিদের মধ্যে বেকারত্বের হার সর্বনিম্ন ছিল, তাহাদের মধ্যে জার্মানি অন্যতম। তাহা সম্ভবপর হইয়াছে সেই দেশের কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা ‘ভোকেশনাল এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং’ বা ভেট-এর সূত্রেই। কেন্দ্রীয় সরকার ও শিল্পমহল মিলিয়া ব্যবস্থা করে এই প্রশিক্ষণের। দক্ষ কর্মী গড়িবার প্রক্রিয়াটি শুরু হয় বিদ্যালয় স্তর, বিশেষত, নবম বা দশম শ্রেণি হইতে। শিক্ষার বিষয় অনুযায়ী, সময় লাগে দুই হইতে সাড়ে তিন বৎসর। দ্বৈত পদ্ধতিতে চলে প্রশিক্ষণ। সরকার পরিচালিত কারিগরি বিদ্যালয়গুলিতে ভর্তি হইলেও সেখানে তাহারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাত্ত্বিক শিক্ষালাভ করে সপ্তাহে এক বা দুই দিন। বাকি দিনগুলিতে তাহাদের সংশ্লিষ্ট সংস্থায় দক্ষ প্রশিক্ষকের তত্ত্ববধানে হাতে-কলমে কাজ শেখানো হয়। তবে শুধু কারিগরি শিক্ষাই নহে, চাকুরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ‘সফট স্কিল’-এর প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। সংস্থায় কাজ করিবার সূত্রে তাহাদের দেওয়া হয় প্রশিক্ষণ ভাতাও। কোর্স শেষে হয় পরীক্ষা। তাহাতে উত্তীর্ণ হইলে মেলে শংসাপত্র, যাহা শিক্ষার্থীকে কর্মক্ষেত্রে দক্ষ কর্মী হিসেবে পেশ করিতে সাহায্য করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে হেতু কর্মমুখী প্রশিক্ষণের কথাটি গুরুত্ব সহকারে ভাবিতেছে, জার্মানির উদাহরণটি নিশ্চয়ই সরকারের নিকট অনুসরণযোগ্য হইতে পারে।
প্রশ্ন উঠিবে, যে রাজ্যে শিল্প নাই, সেখানে দক্ষ কর্মী প্রস্তুত করিয়া কী লাভ? চাকুরি আসিবে কোথা হইতে? রাজ্যে শিল্পোন্নয়ন হইলে চাকুরির সংখ্যা বাড়িবে, তাহা সত্য— কিন্তু যত দিন না শিল্পে উন্নত হয়, তত দিন পশ্চিমবঙ্গ ভিন্রাজ্যের শিল্পসংস্থায় দক্ষ শ্রমিক সরবরাহের কাজ করিতে পারে। বিভিন্ন রাজ্যের শিল্পসংস্থার সহিত চুক্তিবদ্ধ হইয়া রাজ্য সরকার তাহাদের প্রয়োজন অনুসারে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে পারে। কাজটি যে শুধুই সরকারের, তাহা নহে— সরকার পথ দেখাইলে বেসরকারি সংস্থাও এই প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজ করিবে। সরকার এই বিষয়ে বাড়তি উদ্যোগী হইলে শিল্পমহলেরও উৎসাহ বাড়িবে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা বাড়িবে। কারিগরি প্রশিক্ষণে দক্ষ হইলে কর্মসংস্থান হইতে পারে— এই ভাবনাটি আত্মস্থ করিলে ছাত্রছাত্রীদের একটি বড় অংশ কারিগরি শিক্ষামুখী হইবে বলিয়া আশা করা যায়।