মিঠুন চক্রবর্তী। —ফাইল চিত্র।
রাজনীতি ও অভিনয় দুটোতেই ভাষা খুব জরুরি বিষয়, রাজনীতিবিদ ও অভিনেতা উভয়কেই তা বাগে আনতে হয়। অভিনেতার সুবিধা, তিনি মূলত তৈরি সংলাপ আওড়ান, পর্দার ভাষার নৈতিক দায় তাঁর নেই। রাজনীতিবিদের তা নয়, তাঁর একটি কথায় আগুন জ্বলতে পারে, প্রবল হিংসা নেমে আসতে পারে, সে জন্যই কোথায় কোন কথাটা বলা দরকার আর কোনটি কদাচ নয়, তাঁকে তা নিরন্তর শিখতে হয়। সমস্যা হয় অভিনেতা রাজনীতিক বনে গেলে, এত দিন যিনি ছিলেন তৈরি ভাষায় সিদ্ধহস্ত, তাঁকে মুখে তুলে নিতে হয় একটি নির্দিষ্ট দলের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ভাষা, ছন্দ-অলঙ্কার-ইশারা সমেত। কারও ক্ষেত্রে অবশ্য এই রূপান্তরও হয়ে ওঠে অনায়াস: কলকাতায় বিজেপির সদস্যপদের প্রচার সংক্রান্ত এক সভায় সম্প্রতি মিঠুন চক্রবর্তী যে ভাষায় কথা বললেন তাতে বোঝা গেল, তাঁর দলের চিরাচরিত বয়ানটি তিনি বিলক্ষণ রপ্ত করেছেন।
এই বয়ান উগ্রতা ও ঘৃণার, যার অবিসংবাদিত লক্ষ্য সংখ্যালঘুরা। গৈরিক জাতীয়তাবাদী নেতা-মন্ত্রীরা যে সারা দেশে এই ঘৃণা ছড়ানোর কাজটিকে তাঁদের প্রধানতম প্রকল্প হিসাবে হাতে নিয়েছেন, এ আর নতুন কথা নয়। তবু বিস্ময় ও আতঙ্ক জাগে, এক জন জনপ্রিয় প্রবীণ অভিনেতাও কত স্বচ্ছন্দে ঘৃণাভাষণ ছুড়ে দেন তা দেখে। ২০২৬-এ ‘মসনদ’ জিততে তাঁর দল ‘যে কোনও কিছু’ করতে প্রস্তুত, এই ইশারাতেই সেই বিদ্বেষ চাপা থাকে না, তৃণমূলের সংখ্যালঘু নেতার সমধর্মী এক বিদ্বেষ-ভাষণের প্রসঙ্গ টেনে এনে তিনিও হুমকি দেন পাল্টা প্রতিহিংসার। মনে রাখা দরকার, অভিনেতা-নেতা এ রকম কথা আগেও বলেছেন, তাঁরই অভিনীত চরিত্রের জনপ্রিয় সংলাপ থেকে সাপ ও ছোবলের অনুষঙ্গ মনে করিয়ে দিয়ে নিজেকে তুলে ধরেছেন ‘বিষধর সাপ’ হিসাবে। সে বার হইচই থেকে হাসাহাসি সবই হয়েছিল, এ বার থানায় এফআইআর দায়ের হয়েছে। তাতে যে মুখের ভাষায় রাশ টানা হবে সে আশা নেই, অন্তত গৈরিক জাতীয়তাবাদীদের কাছে: তাদের রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি হল ধর্মীয় মেরুকরণ আর তার প্রথম ও প্রধান অস্ত্রটিই ঘৃণাভাষণ, সেও গেলে আর রইল কী।
বিদ্বেষ বা ঘৃণাভাষণের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে তার স্থান-কালও। পশ্চিমবঙ্গে যে ছ’টি বিধানসভা আসনে উপনির্বাচন হচ্ছে তার একটিমাত্র বিজেপির দখলে— এই পরিস্থিতিতে ভোটের প্রচারে এবং বেশি বেশি সদস্য ও সমর্থক নিজেদের দিকে টানতে বিজেপি নেতারা বদ্ধপরিকর। কলকাতায় যে সভামঞ্চ থেকে অভিনেতার বিষোদ্গার, সেটিও ছিল এক সদস্য-বৃদ্ধি অভিযান, সেখানে এসেছিলেন খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর উপস্থিতিতে প্রবীণ অভিনেতা যে বিদ্বেষ ছড়ানোর সহজ ও সময়সিদ্ধ কৌশলটি বেছে নেবেন সেটাই স্বাভাবিক, অমিত শাহও একই কাজে ও ভাষায় দৃশ্যত সিদ্ধহস্ত। তাই আশঙ্কা হয় যে, এই প্রবণতাটি যাওয়ার নয়— বরং ক্রমাগত বেড়ে চলার, ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের আবহে তা আরও ফুলেফেঁপে উঠবে। বিদ্বেষের কারবারিদের কাছে রাজনৈতিক সদাচরণ ও ভাষিক সৌজন্য আশা করে কিছুমাত্র লাভ নেই, কিন্তু দুঃখ হয় এক জন লোকপ্রিয় শিল্পীর রাজনৈতিক স্খলন দেখে। শিল্পী হবেন সংবেদনশীল, মানবিক; উগ্রতা ও সহিংসতা তাঁর সঙ্গে খাপ খায় না, পর্দায় হলেও বাস্তবে নয়, এমনকি রাজনীতির অঙ্গনেও নয়— এই মৌলসত্যের ভাঙচুর দেখে।