দিল্লির সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনায় ফেসবুকের ভূমিকা যে খুব অকিঞ্চিৎকর নহে, স্মরণ করাইয়া দিল সুপ্রিম কোর্ট। দিল্লি বিধানসভার প্রিভিলেজ কমিটি ফেসবুক কর্তাকে তলব করিয়াছিল— তাহা ঠেকাইতে এই আমেরিকান বহুজাতিক সংস্থা দেশের শীর্ষ আদালতে আবেদন করিয়া বলিয়াছিল যে, তাহারা প্ল্যাটফর্মমাত্র। সেই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করিয়া কেহ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষ ছড়াইলেও তাহার দায় ফেসবুকের উপর বর্তায় না। শীর্ষ আদালতের বেঞ্চ এই আবেদনটি খারিজ করিয়া দিয়াছে। আদালতের সিদ্ধান্তটি স্বাগত। শুধু দিল্লির ঘটনাতেই নহে, যে প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করিয়া দেশ জুড়িয়া বিদ্বেষ ছড়ানো হয়, তাহার কিছুমাত্র দায় থাকিবে না, তাহা কি সম্ভব? বিশেষত, ভারতে ফেসবুকের বিরুদ্ধে একাধিক বার অভিযোগ উঠিয়াছে যে, তাহারা শাসক দলের মন রাখিতে তাহাদের বিবিধ অন্যায়ে চোখ বুজিয়া থাকে। অভিযোগের ধাক্কা সামলাইতে শেষ অবধি ভারতে ফেসবুক-কর্ত্রী পদত্যাগও করিয়াছেন। ফেসবুকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলি উঠিয়াছিল, তাহার অধিকাংশই বিদ্বেষে প্রশ্রয় দিবার। অর্থাৎ, বিদ্বেষ ছড়াইবার ক্ষেত্রে তাহাদের ভূমিকা অকিঞ্চিৎকর নহে। কিন্তু, এই অভিযোগগুলির কথা যদি ভুলিয়াও যাওয়া যায়, তবুও, তাহাদের পরিসরটিকে কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কোন উদ্দেশ্যে, কী ভাবে ব্যবহার করিতেছে, তাহার দিকে নজর রাখিবার দায়িত্ব সংস্থাটি এড়াইবে কোন যুক্তিতে?
যে যুক্তিটি আকছার ব্যবহৃত হইয়া থাকে, তাহা বাক্স্বাধীনতার যুক্তি। ভারতীয় সংবিধান নাগরিকদের অবাধ মতপ্রকাশের অধিকার দিয়াছে, ফলে সমাজমাধ্যমে কেহ নিজের মত প্রকাশ করিতে চাহিলে তাঁহাকে বাধা দেওয়া এই সংবিধানসিদ্ধ অধিকারে হস্তক্ষেপ— যুক্তিটি এই রূপ। যাহা বলা হয় না, তাহা হইল— সংবিধানে যে অধিকারটি দেওয়া হইয়াছে, তাহা সীমাহীন নহে। কাহারও মতামত যদি অন্য কাহারও অধিকারে হস্তক্ষেপ করে, সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত করে, তবে সেই মত প্রকাশের অধিকার সংবিধান দেয় নাই। অতএব, যে বার্তায়-ছবিতে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি হয়, বাক্স্বাধীনতার দোহাই পাড়িয়া তাহাকে বাঁচাইয়া রাখা প্রকৃত প্রস্তাবে নিরপেক্ষতা নহে— তাহা পক্ষপাত। যে পক্ষ বিভেদ ঘটাইতে চাহে, সমাজের শান্তি বিনষ্ট করিতে চাহে, তাহার প্রতি পক্ষপাত। অন্য দিকে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পদত্যাগ দাবি করিয়া হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করিলে ফেসবুক তাহাকে আটকাইয়া দেয়। ইহাও পক্ষপাত, এবং প্রথম পক্ষপাতটিরই ভিন্ন রূপ। অর্থাৎ, ভারতের সামাজিক পরিসরে যে বিবাদ চলিতেছে, ফেসবুক তাহার একটি পক্ষ। সুতরাং, দায় তাহারও। প্রসঙ্গত, শীর্ষ আদালতও এই কথাটি স্মরণ করাইয়া দিয়াছে যে, তাহাদের পরিসরে চলা রাজনৈতিক বিবাদে জড়িত থাকা ফেসবুকের ব্যবসার চরিত্রের অপরিহার্য অঙ্গ।
দেশের শান্তি বা নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, এমন কোনও উপাদানকে সমাজমাধ্যমের পরিসরে রাখিতে দেওয়া যায় না, এ কথা যেমন সত্য, তেমনই ইহাও সত্য যে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জিগির তুলিয়া নাগরিকের সৎ মতামতকে রুদ্ধও করা যায় না। মধ্যস্বত্বভোগী ইন্টারনেট সংস্থাগুলির জন্য যে আইন কেন্দ্রীয় সরকার প্রণয়ন করিয়াছে, এবং যাহার পরিপ্রেক্ষিতে টুইটারের সহিত সরকারের সংঘাতের মাত্রা প্রতি দিন চড়িতেছে, এই প্রসঙ্গে সেই আইনটির কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন।
এখানেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার গুরুত্ব। যে হেতু অভিজ্ঞতা বলিতেছে যে, শাসকরা জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থকে স্থান দিতে অভ্যস্ত, ফলে তাহাকে গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধ রাখিবার কাজটি বিরোধীদের, নাগরিক সমাজকে করিতে হইবে। আদালত নিজের দায়িত্ব পালন করিয়াছে। সমাজকেও নিজের কাজ করিতে হইবে।