—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
রাজনীতিতে একটি বহুল-আচরিত প্রবণতা হল, কয়েকটি প্রতীক বা প্রসঙ্গকে দলীয় ভাবে বেছে নিয়ে ক্রমাগত তাকে রাজনৈতিক বয়ানে চারিয়ে দেওয়া। ক্ষমতাসীন দল তাকে শাসনতন্ত্রেরও অঙ্গীভূত করে নেয়, তাতে জনমত ও জনাবেগ, দুই-ই হয় পাকাপোক্ত। বিজেপি দল ও জোটের আমলে গত দশ বছরে গরু এমনই এক প্রতীক হয়ে উঠেছে। এ দেশে ধর্মীয় ও কৃষি কৌমে গরুর ভূমিকা আবহমান কাল থেকেই, তাকে ঘিরে এক প্রকার আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতাও তৈরিই ছিল। তাই গরুকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক বয়ানের অন্যতম মুখ্য প্রতীক করে তুলতে বিজেপিকে বেগ পেতে হয়নি। নানা রাজ্যে তার জোটসঙ্গী বা সমর্থিত দল যেখানে ক্ষমতায়, তাদেরও না।
যেমন দেখা গেল অতি সম্প্রতি মহারাষ্ট্রে। একনাথ শিন্দের মন্ত্রিসভা খাঁটি ভারতীয় গরুকে ‘রাজ্যমাতা’ আখ্যা দিয়েছে। উপাধি বা আখ্যার প্রয়োগে বিজেপির জুড়ি নেই, তার সঙ্গীরাও কিছু কম নয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য গরু ঘিরে মহারাষ্ট্র সরকারের একগুচ্ছ কর্মসূচিও ঘোষিত: ২০১৯ সালের গণনা অনুযায়ী মহারাষ্ট্রে দেশি গরুর সংখ্যা কমেছে ২০ শতাংশেরও বেশি, গোশালাগুলিতে যাতে খাঁটি এদেশীয় গরু সংখ্যায় বাড়তে পারে, সেই লক্ষ্যপূরণ আসল উদ্দেশ্য, মহারাষ্ট্র গোসেবা কমিশন তাদের যত্নআত্তির জন্য গোশালাগুলিকে দিনপ্রতি ৫০ টাকা করে ভর্তুকি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। আবার রাজ্যের কৃষি, ডেয়ারি উন্নয়ন, পশুপালন ও মৎস্য দফতর সরকারি ঘোষণায় এরই সূত্র ধরে উল্লেখ করেছে অরগ্যানিক কৃষিতে গোবর-সারের প্রয়োজনীয়তা থেকে শুরু করে মানুষের পুষ্টিবিধানে গোদুগ্ধের গুরুত্বের দিকটিও।
সরকারের ঘোষিত প্রস্তাব ও কর্মসূচিগুলি যেখানে সরাসরি কাজের কথা বলতে পারত; কৃষি ও কৃষি-অর্থনীতি, পশুপালন ও ডেয়ারি উন্নয়নের মতো ক্ষেত্রগুলিতে ভারতীয় জাতের গরুর বাড়বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয়তার কথাটি সোজাসুজি তুলে ধরতে পারত, সেখানে মহারাষ্ট্র সরকার বেছে নিয়েছে ঘুরপথ: ‘রাজ্যমাতা গোমাতা’ আখ্যায় ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার। আসলে এই ঘুরপথটিই কেন্দ্রে বিজেপি বা রাজ্যে রাজ্যে তাদের সমর্থিত শাসক দলগুলির মূল পথ হয়ে উঠেছে, কারণ এতে সরকারের পরিকাঠামো ব্যবহার করে দলীয় রাজনীতির স্বার্থসিদ্ধি করা যায় অতি সহজে। মহারাষ্ট্রে বিধানসভা নির্বাচন এগিয়ে আসছে সেটাও মাথায় রাখার, দু’বছর আগের রাজনৈতিক ডামাডোলের জেরে বিজেপির হাত ধরে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বসা একনাথ নিশ্চিত ভাবেই চাইবেন ভবিষ্যতের পথ ও তখ্ত পোক্ত করতে। জনমত তথা ভোটব্যাঙ্কই ভরসা, আর তাকে নিজেদের দিকে টেনে আনতে বিজেপির পদাঙ্ক অনুসরণের মার নেই— জনসমাজের একটা বৃহৎ অংশের আবেগ যাকে ঘিরে আবর্তিত তাকে একটু নতুন আলোয় তুলে ধরা। কৃষি ও পশুপালনে গরুর গুরুত্ব তুলে ধরে শিবসেনা সরকারের যত না লাভ, রাজ্যে খাঁটি ভারতীয় গরু কমে যাচ্ছে বলে সরকারের সকাতর উদ্বেগ প্রকাশ আর ‘রাজ্যমাতা’ ঘোষণায় ভজন-পূজন-সেবায় লাভ ঢের বেশি। প্রথমটি নিতান্ত কেজো পদক্ষেপ, যে কোনও সরকারই হয়তো করবে; দ্বিতীয় পথটি এ ক্ষেত্রে সরকার ও দল দুইয়েরই পথ প্রশস্ত করবে। সবচেয়ে বড় কথা, এ কাজে শাসক দলকে বেগও পেতে হল না, গরু ও জনাবেগ দুই-ই সহজে দুইয়ে নেওয়া গেল।