আধুনিক দাসত্ব।
চার কোটি থেকে পাঁচ বছরে বেড়ে পাঁচ কোটি। গৌরবের নয়, এই বৃদ্ধি লজ্জার কারণ। গভীর দুশ্চিন্তারও। পরিসংখ্যানটি দাসত্বের। ‘আধুনিক দাসত্ব’ বিষয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (আইএলও)-এর সর্বশেষ সমীক্ষার রিপোর্ট জানাচ্ছে, এই পাঁচ কোটি মানুষ সে-কালের ক্রীতদাসদের মতোই মালিকের কাছে বাঁধা পড়ে আছেন, তাঁদের অন্যত্র যাওয়ার বা কাজ করার স্বাধীনতা নেই। আজ আর সাধারণত বাজারে গিয়ে দাসদাসী কিনে আনা যায় না, দুনিয়া আধুনিক হয়েছে। কিন্তু ক্রীতদাসদের জীবনের সঙ্গে এই আধুনিক দাসত্বের মৌলিক পার্থক্য কমই। দীর্ঘ সময়ের জন্য— অনেক ক্ষেত্রে, যত দিন কর্মক্ষমতা থাকে তত দিনের জন্য— মালিকের কাছে বাঁধা পড়ে থাকাই আধুনিক দাসজীবনের নিয়তি। লক্ষণীয়, আইএলও পাঁচ কোটি দাসকে দু’টি ভাগে ভাগ করেছে— পৌনে তিন কোটিকে জোর করে শ্রমিক হিসাবে খাটানো হচ্ছে; সওয়া দু’কোটির জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, এই বিবাহিতরাও পুরোদস্তুর দাস-শ্রমিক, ষোলো আনার উপরে বত্রিশ আনা। দাস-শ্রমিকের প্রকৃত সংখ্যাটি নিঃসন্দেহে সমীক্ষালব্ধ পরিসংখ্যানের তুলনায় অনেক বেশি, কারণ বহু দাসত্বই সমীক্ষায় ধরা পড়ে না, ধরা সম্ভব নয়। বিশেষত, পারিবারিক বা সামাজিক ঘেরাটোপের আড়ালে যে দাস-শ্রম লুকিয়ে থাকে, তাকে খুঁড়ে বার করা অনেক সময়েই অতি বড় সত্যান্বেষীরও অসাধ্য।
এই সূত্রেই প্রশ্ন উঠতে পারে, আপাতদৃষ্টিতে যে শ্রমিকরা কারও কাছে বাঁধা নন, তাঁদেরও কি যথার্থ স্বাধীনতা আছে? কাজের বাজারে কাজ খুঁজে নেওয়ার অধিকার তাঁদের আছে, কিন্তু ঠিকঠাক কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা কোথায়? বাস্তবের চাপে তাঁরা কি যে কাজ পাচ্ছেন, তা যত কষ্টকর হোক এবং তার বিনিময়ে যত কম টাকাই পান, সেটাই করতে এবং করে যেতে বাধ্য হন না? এ-ও কি এক ধরনের দাসত্ব নয়? প্রশ্নটি কেবল যুক্তিসঙ্গত নয়, গুরুত্বপূর্ণ। ‘ওয়েজ স্লেভারি’ বা মজুরি-দাসত্বের ধারণা নতুন নয়, আজও অগণিত শ্রমজীবী তার শৃঙ্খলেই বন্দি। কিন্তু আইএলও যে দাসত্বের সমীক্ষা করেছে, তার চরিত্র স্বতন্ত্র। এখানে ‘কার্যত’ দাস-জীবন যাপনের কথা হচ্ছে না, এক জন মানুষকে জোর করে অন্য মানুষের কাছে কাজ করার জন্য আবদ্ধ রাখা হচ্ছে, তাঁর অন্যত্র যাওয়ার বা কাজ খোঁজার অধিকারও নেই। সেই কারণেই একুশ শতকের তৃতীয় দশকে বিপুল দাসত্বের— এবং তার মাত্রা বেড়ে চলার— পরিসংখ্যানটি বিশেষ ভাবে মর্মান্তিক। সভ্যতার পক্ষে এই লজ্জা গোপন করা অসম্ভব।
এই পরিস্থিতির পিছনে কয়েকটি কারণকে প্রধান বলে চিহ্নিত করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন: যুদ্ধবিগ্রহ, গণ-নিপীড়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জীবনজীবিকার বিপর্যয় এবং, অবশ্যই, কোভিড অতিমারি ও তার অনুসারী আর্থিক সঙ্কট। স্পষ্টতই, এই সঙ্কটের জন্য দায়ী অর্থনীতি এবং রাজনীতির যৌথ অভিঘাত, যে অভিঘাত ক্রমশই প্রবলতর হয়ে উঠছে, প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপর্যয় যাতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। অতিমারি তার একটি বিশেষ রূপ, কিন্তু একমাত্র রূপ নয়। অতিমারি বিদায় নেওয়ার পরেও বিপর্যয় চলছে এবং চলবে। আধুনিক দাসত্বের মাত্রাবৃদ্ধি এই নির্মম সত্যটিকেই জানিয়ে দেয় যে, যাকে অগ্রগতির পথ বলে মনে হচ্ছে, সেটি একই সঙ্গে পশ্চাদপসরণেরও পথ, আলো থেকে অন্ধকারে যাওয়ার পথ, কারণ সেই পথে এই গ্রহ এবং তার অধিবাসী মানুষের সামনে গভীর সঙ্কট ক্রমশ গভীরতর হয়ে উঠছে। এই সঙ্কট গোটা দুনিয়ার। আইএলও-র হিসাবে, আধুনিক দাসদাসীদের অর্ধেকের বেশি আছেন সম্পন্ন দেশগুলিতে। সমস্যা যদি আন্তর্জাতিক হয়, তার সমাধানের উপায়ও গোটা পৃথিবীকেই একযোগে খুঁজতে হবে।