এক বালকের মনে ভারী ইচ্ছা, সে লেখাপড়া শিখবে। কিন্তু সে কৃষ্ণাঙ্গ দাস, উনিশ শতকের আমেরিকায় তার পড়তে-লিখতে শেখা নিষিদ্ধ। মালকিন তাকে পড়ানো শুরু করেও, মালিকের বকুনি খেয়ে নিরস্ত হয়েছে। বারো বছরের ফ্রেডরিক অবশ্য হাল ছাড়েনি। মালকিন যখনই কোনও কাজে তাকে বাইরে পাঠায়, সে পকেটে রুটি ভরে নেয়। বাল্টিমোরের রাস্তায় দরিদ্র সাদা ছেলের কমতি নেই। তাদের কাউকে পাকড়াও করে ফ্রেডরিক, খানিকটা রুটির বিনিময়ে একটু পড়তে শিখে নেয়। সেই সঙ্গে বই কেনার জন্য পয়সা জমায়। পঞ্চাশ সেন্ট জমা হলে সে কিনে আনল একটা সেকেন্ড হ্যান্ড বই, দ্য কলাম্বিয়ান ওরেটর। সেই বইয়ের একটি রচনা ছিল, এক দাস আর তার মালিকের কথোপকথন। দাসটিকে তার মালিক বোঝাতে চায় যে, বার বার পালানোর চেষ্টা করে সে ভুল করছে। দাসপ্রথার সপক্ষে সমস্ত যুক্তি সাজানো হয় সেই মালিকের বয়ানে। তার প্রত্যেকটিকেই খণ্ডন করে কৃষ্ণাঙ্গ সেই দাস। দাসের যুক্তির জোর ছিল এমনই যে, মালিক স্বেচ্ছায় তাকে মুক্তি দেয়। এই রচনাটি (ডায়ালগ বিটুইন আ মাস্টার অ্যান্ড স্লেভ) ওই বারো বছরের বালকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। “যে সব চিন্তা আমার মনে ঝলসে উঠে মিলিয়ে যেত, প্রকাশ হতে পারত না, সেগুলো এ বার জিহ্বা পেল,” লিখছেন তিনি। সত্যের এত ক্ষমতা যে, তা এক জন দাসমালিকের বিবেককেও জাগ্রত করতে পারে, এই প্রত্যয় থেকে জন্ম নিল দাসপ্রথা-বিরোধী, অকুতোভয় এক বিপ্লবীর।
এই দাস বালক হলেন ফ্রেডরিক ডগলাস (১৮১৮-১৮৯৫)— আব্রাহাম লিঙ্কনের দাসপ্রথা বিলোপের উদ্যোগের অন্যতম সহযোগী, কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার প্রাপ্তির আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা। সর্বোপরি, কৃষ্ণাঙ্গরা যে জড়বুদ্ধি, পশুবৎ জীব নন, মেধা-বুদ্ধিতে তাঁরা শ্বেতাঙ্গদের সমান, ফ্রেডরিক স্বয়ং তার নিদর্শন হয়ে ওঠেন। তাঁর একাধিক আত্মকথার প্রথমটি (ন্যারেটিভ অব দ্য লাইফ অব ফ্রেডরিক ডগলাস, অ্যান আমেরিকান স্লেভ) বইয়ের নামে নীচে লেখা ছিল, ‘রিটন বাই হিমসেল্ফ’— বইটি তিনি নিজেই লিখেছেন। কোনও কৃষ্ণাঙ্গ যে এমন একটি বই লিখতে পারেন, এ কথা সে দিন অনেকেই নস্যাৎ করেছিলেন। ১৮৪৫ সালে প্রকাশিত ন্যারেটিভ অব দ্য লাইফ অব ফ্রেডরিক ডগলাস, অ্যান আমেরিকান স্লেভ বইটির একশো আশি বছর হতে চলল। এই সময়কালে বহু জীবনের গতিধারা বদলে দিয়েছে বইটি, আজও তা মুক্তিকামী মানুষের অমূল্য সম্পদ। যেমন ভাবে ডগলাসের জীবন বদলে দিয়েছিল দ্য কলাম্বিয়ান ওরেটর। গবেষকরা দেখিয়েছেন, এই বইটি (প্রকাশ ১৭৯৭) প্রাচীন কাল থেকে আমেরিকার মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সময়কালের শক্তিশালী বক্তৃতার একটি সঙ্কলন, যেখানে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সাহসের জয়গান রয়েছে। এক প্রদীপ থেকে অন্য প্রদীপ জ্বলার মতো, একটি বই থেকে আর একটি বইয়ে প্রবাহিত চিন্তার ধারা— মানবসভ্যতার সেরা উত্তরাধিকার।
বহু স্বশিক্ষিত, সংগ্রামী মানুষের আত্মজীবনীতে এমন জীবন-ঘোরানো রচনার সন্ধান মেলে। বাংলার বিশিষ্ট শিল্পপতি আলামোহন দাশ (১৮৯৫-১৯৬৯) যখন উনিশ বছরের তরুণ, তখন তিনি কলকাতায় খই ফিরি করতেন। চটের বিছানা, ইটের বালিশে শুয়ে রাতে লম্ফ জ্বেলে পড়তেন ধার-করা বই, পত্রিকা। সে ভাবেই এক দিন একটি পত্রিকায় পড়লেন রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’। খুঁজে পেলেন জীবনের মন্ত্র। খই-মুড়ির কারবার থেকে দাশনগর শিল্প নগরী প্রতিষ্ঠা, এই যাত্রায় শক্তি জুগিয়েছিল ‘বাঙালীর কাজ’ ‘বাঙালীর আশা’, লিখেছেন আত্মজীবনীতে (আমার জীবন, ১৩৫৬)। বইয়ের ভিতরের বইয়ের এই অনুসন্ধান আসলে জীবনের ভিতরের জীবনের খোঁজ। জীবনী-লেখকটি যদি হন সমাজ-সংসারে বিশিষ্ট ব্যক্তি, তখন স্বভাবতই তাঁর জীবনের মোড়-ঘোরানো বইটিও আরও বিশেষ হয়ে ওঠে। তবে প্রত্যেক পাঠকই নিজের মধ্যে বহন করে চলেন এমন কোনও বইকে, যা সোনার কাঠি হয়ে এসেছে তাঁর জীবনে। কখনও মনে-মনে, কখনও কথাবার্তায় নিরন্তর খোঁজ চলে ‘সহপাঠী’ মানুষের। আসলে তাঁরা সহযাত্রী— একটি বই মানসলোকে যে বিবেকদীপ্ত যাত্রাপথ উন্মুক্ত করেছে, সেই পথে হাঁটার সঙ্গী। ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে বন্ধু মেলে, না হলে গাইতে হয় একলা চলার গান। ক্রমহ্রাসমাণ পাঠ্যাভ্যাসের যুগপর্বে যদি এমন জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া বই এবং তার যোগ্য পাঠসঙ্গীর সন্ধান না-ও মেলে, আশা করাই যায় যে, অন্য কোনও মাধ্যম থেকে এ ভাবেই বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করে নিতে পারবে মানুষ।