মাচ্ছু নদীর উপর ভেঙে পড়া সেতু। ছবি: পিটিআই
উৎসবের মরসুমে খুলে দেওয়া ঝুলন্ত সেতুতে উঠে পড়েছিলেন চার-পাঁচশো লোক। তার পরেই ভেঙে পড়ল গুজরাতের মোরবীর সাসপেনশন ব্রিজ, মচ্ছু নদীতে সলিলসমাধি হল ১৪১টি প্রাণের, নিখোঁজ শতাধিক, আহত অজস্র। অতিমারির ছায়া সরিয়ে জেগে-ওঠা বছরের শেষ পর্বে এ-হেন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, সান্ত্বনাতীত। তবু কিছু প্রশ্ন ওঠা দরকার। প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো সেতুটি সংস্কারের বরাত বেসরকারি ‘ওরেভা’ সংস্থাকে দিয়েছিল গুজরাত সরকার। বলা হয়েছিল কাজ চলবে আট থেকে বারো মাস, কিন্তু সেতু খুলে গেল ছ’মাসের মধ্যেই। পনেরো বছর দিব্যি চলবে, ঘোষণার পাঁচ দিনের মাথায় ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। এখন জানা যাচ্ছে পুরসভার ‘ফিটনেস সার্টিফিকেট’ ছাড়াই সেতু খুলে দেওয়া হয়েছে, তাড়াহুড়ো করে। উৎসব, জনগণ ও সর্বোপরি আসন্ন গুজরাত বিধানসভা নির্বাচন, সবই বড় বালাই। তবু যে গাফিলতির জেরে এতগুলি মানুষের প্রাণ চলে যায় তার কোনও ক্ষমা নেই, সেতু সংস্কারকারী সংস্থা ও ভূপেন্দ্র পটেলের সরকার, দুই-ই সমান অপরাধী। এমন দুর্ঘটনার পর যা দস্তুর তা-ই হয়েছে, গুজরাত সরকার ও সংশ্লিষ্ট পুরসভার পারস্পরিক দোষারোপ ও দায় ঠেলাঠেলি অব্যাহত। কিন্তু নাগরিকেরও কি দোষ নেই? যে সেতুতে এক সঙ্গে সর্বোচ্চ কত জনের ওঠা উচিত তা নির্দিষ্ট, তখন কী করে কয়েকশো মানুষ উঠে পড়লেন? কিছু অত্যুৎসাহী যুবক নাকি সেতু ধরে ঝাঁকাচ্ছিলেন, তার জেরে সেতু ভেঙে পড়লে সংস্কারকাজের ব্যর্থতা ও স্থানিক নিরাপত্তাহীনতার দিকেই আঙুল ওঠে— এবং মাত্রাজ্ঞানহীন অভব্য নাগরিকের দিকেও।
স্বাভাবিক ভাবেই রাজনীতির অঙ্গনে ঝড় উঠেছে। বিরোধী দলগুলি সরব, বিশেষত গুজরাত বিধানসভা ভোটের আবহে বিজেপিকে জোর ধাক্কা দিতে এই ঘটনা বিরোধীদের হাতিয়ার হয়ে উঠছে। দেড় দিন পরে হলেও প্রধানমন্ত্রী অকুস্থলে গিয়েছেন, উদ্ধারকাজ নিয়ে বৈঠক করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্ত সংস্থার বোর্ড প্রকাশ্যে ঢাকা দেওয়ার ব্যবস্থাও হয়েছে। দুর্ঘটনা নিয়ে রাজনীতি ভারতে নতুন নয়, অনেক সময়ই তা গড়ায় বাদ-বিসংবাদ ও কুরুচিকর তরজায়। ভবিষ্যতে কংগ্রেস ও বিরোধী দলগুলির সুর চড়বে কি না তা দেখার, তবু কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর তাৎক্ষণিক শমিত মন্তব্যটি আশা জাগায়: বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে, এ নিয়ে রাজনীতি করলে মৃতদের অপমান করা হবে। এর বিপ্রতীপে মনে পড়তে পারে ২০১৬-র পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটের আগে কলকাতায় পোস্তা উড়ালপুল ভেঙে পড়ার ঘটনায় নরেন্দ্র মোদীর মন্তব্য, দুর্ঘটনাটিকে তিনি বলেছিলেন ‘ভগবানের বার্তা’, রাজ্য সরকার কী ভাবে চলছে তা বোঝাতে ঈশ্বর বার্তা পাঠিয়েছেন। কোন পরিস্থিতিতে কী বলতে হয়, কখন রাজনৈতিক লাভের গুড়ের হাঁড়িটি সরিয়ে রেখে মানবিকতার বোধে পাশে এসে দাঁড়াতে হয় সেই সিদ্ধান্তটি রুচি ও শিক্ষার ব্যাপার, কংগ্রেস নেতারা অন্তত এই সেতু-দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় রাহুল গান্ধীর উদাহরণটি অনুসরণ করতে পারেন।
অসতর্কতায় মহা দুর্ঘটনা ঘটে যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার সোলে সঙ্কীর্ণ পথে দেড়শোরও বেশি মানুষের পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুই প্রমাণ। ভারতে নানা রাজ্যেও এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে, পশ্চিমবঙ্গও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু প্রশাসনের তরফে দুর্ঘটনা-পরবর্তী তদন্ত ও প্রতিকারের পদক্ষেপ সব রাজ্যে সমান ভাবে ঘটেনি, ঘটে না; কোথাও কোথাও তা স্রেফ আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও নামমাত্র তদন্তেই সীমাবদ্ধ। শিল্প, পূর্ত-সহ নানা ক্ষেত্রে গুজরাত সরকারের প্রশাসনিক দক্ষতার কথা শোনা যায়, এখন দুর্ঘটনার পরে কড়া ব্যবস্থাও হবে আশা করা যায়। প্রকৃতপক্ষে এমন একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি ও পদক্ষেপেই বোঝা যায় তার অধঃপতন বা অভ্যুদয়ের রেখচিত্র। সেটা বিশেষ করে মনে রাখার।