আমাদের বামপন্থীরা কি শিখবেন

মুনাফা উসেইন বোল্ট-এর গতিতে দৌড়বে, এটাই মর্গান স্ট্যানলিদের এক এবং একমাত্র লক্ষ্য। সেই দৌড়ের পথে কোনও রকম বাধা দেয় যারা, তারা পুঁজির শত্রু, অতএব সভ্যতার শত্রু।

Advertisement

চিরদীপ উপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share:

মর্গান স্ট্যানলি-র মাতব্বররা যখন জেরেমি করবিনের দিকে ঢিল ছুড়েছিলেন, ভাবেননি এমন পাটকেল খাবেন। মর্গান স্ট্যানলি নামজাদা ফিনান্স কোম্পানি— লগ্নিপুঁজির বিশ্ববাজার শাসন করে যে সব অতিকায় সংস্থা, তাদের প্রথম সারিতে এই কোম্পানির স্থান। মুনাফা তার প্রাণেশ্বর। সেই মুনাফা উসেইন বোল্ট-এর গতিতে দৌড়বে, এটাই মর্গান স্ট্যানলিদের এক এবং একমাত্র লক্ষ্য। সেই দৌড়ের পথে কোনও রকম বাধা দেয় যারা, তারা পুঁজির শত্রু, অতএব সভ্যতার শত্রু।

Advertisement

যেমন জেরেমি করবিন (ছবিতে)। ব্রিটিশ লেবার পার্টির এই নেতা ক্রমাগত বাজার অর্থনীতির ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ জারির পক্ষে সওয়াল করে আসছেন, গ্যাস থেকে শুরু করে রেল পর্যন্ত বিভিন্ন বেসরকারি পরিষেবার জাতীয়করণের দাবি জানাচ্ছেন, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ক্ষমতায় এলে বড়লোকদের উপর কর বাড়াবেন, সরকারি কোষাগার থেকে ভরতুকি বাড়িয়ে উচ্চ শিক্ষার খরচ কমাবেন। সোজা কথায়, মার্গারেট থ্যাচার ব্রিটেনে রাষ্ট্রের এক্তিয়ার খর্ব করে বাজার অর্থনীতির আগল খুলে যে নয়া জমানা এনেছিলেন, সাড়ে তিন দশক পরে করবিন তার অবসান ঘটিয়ে চাকা ঘোরাতে চান উলটো দিকে— বাঁ দিকে।

লগ্নিপুঁজির দুনিয়াদাররা এমন আপদ বিদেয় করতে তৎপর হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। সাধারণত তাঁরা সরাসরি রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন না। বশংবদ রাজনীতিক, পত্রপত্রিকা, মিডিয়াশোভন অর্থনীতিবিশারদ ইত্যাদিরাই তাঁদের হয়ে কথা বলেন, জনমতের ওপর গ্লোবাল ক্যাপিটালের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় প্রবল উদ্যমে প্রচার করে চলেন। এবং তাঁরা রীতিমত সফলও বটে— ‘মুক্ত অর্থনীতি’র যে দর্শনকে তাঁরা এ-যুগে বিজ্ঞানসম্মত নিরপেক্ষ একটি তত্ত্ব হিসেবে চালিয়ে দিয়েছেন, সেটি আসলে বিশ্বপুঁজির নিজস্ব স্বার্থ পূরণের ফিকির বই কিছু নয়। সুতরাং তাত্ত্বিকরা তত্ত্ব করবেন, মর্গান স্ট্যানলিরা মুনাফা— লগ্নিপুঁজির ছকখানি দিব্যি চলে এসেছে। কিন্তু অধুনা সেই রাজ্যপাট ঈষৎ টলোমলো, ২০০৮ সালে সেই যে লগ্নিপুঁজির বাজারে ধস নামল, তার পর থেকে বিশ্বজনীন ধনতন্ত্র কিছুতেই তার পুরনো আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছে না, খোলাবাজারের জয়গানে মুক্তকচ্ছ অর্থনীতিবিশারদদেরও যেন সেই দাপট নেই। মানে, পাবলিক তাঁদের আজকাল তেমন পাত্তা দিচ্ছে না।

Advertisement

ফলে লগ্নিপুঁজির সারথিদের সরাসরি ময়দানে নামতে হচ্ছে। সম্প্রতি মর্গান স্ট্যানলির একটি রিপোর্টে জানানো হয়েছে— ব্রেক্সিট-এর ব্যাপারটা সামলাতে নাজেহাল হয়ে প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে বছরখানেকের মধ্যে ইস্তফা দিতে পারেন এবং জেরেমি করবিনের নেতৃত্বে নির্বাচনে জয়ী হয়ে নতুন সরকার গড়তে পারে লেবার পার্টি। যদি তা হয়, ব্রিটেনের অর্থনীতির পক্ষে সেটা হবে ব্রেক্সিটের থেকেও ভয়ংকর, কারণ করবিনের (বামপন্থী) নীতি ব্রিটিশ ব্যবসা-বাণিজ্যের বিরাট ক্ষতি করবে। এমনকী কনজার্ভেটিভ পার্টি যদি জনমত সমীক্ষায় ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তে থাকে, তা হলে বাজারের হাড়ে কাঁপুনি ধরবে। মোদ্দা কথা, করবিন ব্রিটিশ অর্থনীতির পক্ষে বিপজ্জনক, দেশের স্বার্থে তাঁকে দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট থেকে দূরে রাখা দরকার।

এই অ-সামান্য আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে লেবার পার্টির নেতা যা বলেছেন এবং যে ভাবে বলেছেন, তাকে অসামান্য বললে কম বলা হয়। করবিনের সাফ জবাব: ঠিকই বলেছ, আমরা সত্যিই তোমাদের পক্ষে বিপজ্জনক। তাঁর বক্তব্য, মর্গান স্ট্যানলির মতো ব্যাংকাররা হল ‘সেই সব ফাটকাবাজ এবং জুয়াড়িদের গোত্রে, যারা ২০০৮ সালে (আন্তর্জাতিক লগ্নি বাজারের বিপর্যয় ঘটিয়ে) আমাদের অর্থনীতিকে ডুবিয়েছিল।’ তার পরেও তাদের কোনও শাস্তি হয়নি, বরং এই সব সংস্থার কর্তারা বিপুল অঙ্কের মাইনে ও বোনাস ঘরে তুলে চলেছেন, যখন লক্ষ লক্ষ কর্মী চাকরি হারিয়েছেন বা অর্ধেক মাইনেয় কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। লেবার পার্টি এই মাতব্বরদের চক্ষুশূল হবে, এটাই স্বাভাবিক, না হলেই উদ্বেগের কারণ ঘটত।

ব্রিটিশ রাজনীতিতে করবিনের এই বামপন্থী সাফ-কথা খুব সুলভ নয়, বিশেষ করে টোনি ব্লেয়ার লেবার পার্টিকে ‘নিউ লেবার’ বানানোর পর থেকে। লক্ষণীয়, করবিনের স্পষ্টভাষণ তাঁর দলকে রাজনৈতিক লড়াইয়ে পায়ের নীচে শক্ত জমি দিয়েছে। অনেক কাল পরে লেবার পার্টি ব্রিটিশ রাজনীতির চালকের আসনে। তার পিছনে অবশ্য ডেভিড ক্যামেরনের আত্মঘাতী ব্রেক্সিট গণভোট এবং তাঁর উত্তরসূরি টেরেসা মে-র সার্বিক ব্যর্থতার বিরাট ভূমিকা আছে। কিন্তু জমি তৈরি থাকলেই যে বিরোধী নেতৃত্ব তাতে ভাল ফসল ফলাতে পারেন, তা তো নয়! করবিন পারছেন।

জেরেমি করবিনের সাহসী রাজনীতি থেকে ভারতীয় বামপন্থীদের স্বধর্মে স্থিত থাকার শিক্ষা নেওয়ার আছে। করবিন যখন লেবার পার্টির নেতৃত্ব দখলের জন্য লড়াই শুরু করেন, তখন দলের মাতব্বররা প্রায় সমস্বরে তাঁর বিরুদ্ধে বলেছিলেন। তাঁদের মতে, করবিন অতি-বাম, তাঁর পাল্লায় পড়লে লেবার পার্টির ক্ষতি হবে। কিন্তু দলের বৃহত্তর সমর্থক গোষ্ঠী সে কথা মানেনি, তারা প্রবল উদ্যমে করবিনের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং সেই দেওয়ান-ই-আম-এর জোরেই তিনি নেতৃত্ব অর্জন করেন।

আমাদের বামপন্থীরা দলের অন্দরেই ঘুরপাক খাচ্ছেন। বাইরের সমাজের সঙ্গে তাঁদের যোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। তাঁদের পূর্বসূরিরা এক কালে ব্রিটিশ বামপন্থীদের কাছে অনেক কিছু শিখেছিলেন। সে সব অবশ্য প্রায় এক শতাব্দী আগের কথা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement