কলকাতা-সহ গোটা রাজ্য এমনকি, দেশ জুড়েই কোভিড সংক্রমণ দ্রুত হারে বাড়তে শুরু করেছে।
হঠাৎ করে কলকাতা-সহ গোটা রাজ্য এমনকি, দেশ জুড়েই কোভিড সংক্রমণ দ্রুত হারে বাড়তে শুরু করেছে। তার মধ্যেই চোখ রাঙাচ্ছে কোভিডের ওমিক্রন রূপ। কোভিডের অন্যান্য রূপের থেকে ওমিক্রন ঠিক কোথায় আলাদা, কতটা ভয়ঙ্কর, তার চিকিৎসা পদ্ধতিই বা কী? ওমিক্রনের হাত থেকে বাঁচতে গেলে কী কী ভাবে সতর্ক থাকা যায়, এগুলি জানাটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।
ওমিক্রন কী? ওমিক্রন কি কোভিডের থেকে আলাদা?
চিনের উহানে প্রথম যে করোনাভাইরাসের হদিশ মিলেছিল, ওমিক্রন তারই একটি ‘মিউট্যান্ট’ রূপ। গত প্রায় দু’বছর ধরে করোনাভাইরাস বিশ্ব জুড়ে দাপিয়ে বেড়াছে। কোভিড থেকে সুরক্ষিত থাকতে আমরা যেমন একাধিক নিয়মকানুন ও বিধি মানছি, তেমনই করোনাভাইরাসও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালাচ্ছে। সে কারণেই ভাইরাসটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজের রূপ এবং চরিত্রে বদল ঘটাচ্ছে। শুধু করোনা নয়, যে কোনও ভাইরাসই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে এটাই করে। তবে ওমিক্রন করোনার এমনই একটা রূপ, যা অত্যন্ত সংক্রামক বলে দেখা যাচ্ছে।
কেউ করোনার ওমিক্রন রূপে আক্রান্ত কি না, তা নিশ্চিত করা কি খুব কঠিন?
রোগীর লালারসের নমুনা পরীক্ষা বা আরটিপিসিআর থেকে নমুনার নির্দিষ্ট ‘এস’, ‘ই’ এবং ‘এন’ জিনকে চিহ্নিত করা হয়। কোনও ব্যক্তি কোভিডের ওমিক্রন রূপে আক্রান্ত কি না জানতে জিন পরীক্ষা (জিনোমিক সিকোয়েন্সিং) প্রয়োজন। ওই পরীক্ষার মাধ্যমে করোনাভাইরাসের এই বিশেষ রূপে কেউ আক্রান্ত কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়।
ওমিক্রন কি করোনাভাইরাসের আগের রূপগুলির থেকে বেশি প্রাণঘাতী?
এখনও পর্যন্ত যে সমস্ত তথ্য মিলেছে, তা থেকে একটা বিষয় নিশ্চিত যে, করোনার আগের রূপগুলির থেকে ওমিক্রন অনেক অনেক গুণ বেশি সংক্রামক। দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রিটেনের পরিসংখ্যান থেকে অন্তত তেমনই মনে হচ্ছে। তবে কোভিডের আগের রূপ ডেল্টা থেকে ওমিক্রনের অভিঘাত অনেকটাই মৃদু বলা যেতে পারে। আগের থেকে বেশি মানুষ ওমিক্রনে আক্রান্ত হচ্ছেন। দ্রুত ছড়িয়েও পড়ছে এই রূপ। তবে আমার মনে হয়, ওমিক্রন কতটা মারাত্মক, তা এখনই বিচার না করে কোভিড যাতে না হয়, সে ব্যাপারে আমাদের আরও বেশি সতর্ক থাকা উচিত।
ওমিক্রন থেকে সুরক্ষিত থাকতে কোনও বিশেষ সতর্কতা?
সতর্ক থাকার সবচেয়ে সোজা উপায় হচ্ছে নাক-মুখ ঢেকে রাখা। অর্থাৎ মাস্ক পরা। মাস্কই ওমিক্রনের বিরুদ্ধে ঢালের কাজ করবে। নাকের উপর শক্ত ভাবে বসে থাকার জন্য ক্লিপ দেওয়া মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। বাইরে বেরোলে নাক বা মুখের নীচে যাতে মাস্ক না নেমে যায়, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। এ ছাড়া কথা বলার সময় মাস্ক না খোলা উচিত। একসঙ্গে অনেকে মিলে খাওয়াদাওয়া না করাই ভাল। কারণ, খাওয়ার সময় তো মাস্ক পরে থাকা যাবে না। সব সময় একে অপরের সঙ্গে এক মিটারের দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়— নিতে হবে জোড়া টিকা। সম্ভব হলে বুস্টারও।
টিকা কি আমাকে ওমিক্রনের হাত থেকে বাঁচাবে?
টিকা সংক্রমণকে প্রতিহত করতে পারে না। কিন্তু সংক্রমিত হলে টিকা-নেওয়া শরীর ওই সংক্রমণের সঙ্গে জোরদার লড়াই চালাতে পারবে। টিকা গুরুতর অসুস্থতা থেকে বাঁচাতে পারে। তথ্য-পরিসংখ্যান বলছে, কারও টিকা নেওয়া থাকলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজনীয়তাও অনেক ক্ষেত্রে কমে যায়। তবে ১০০ শতাংশ ক্ষেত্রেই যে এমনটা হবে, তা-ও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তাই কোভিড সংক্রমণ যাতে না হয়, সে জন্য মাস্ক পরে সুরক্ষিত থাকাই অন্যতম পথ।
আগে এক বার কোভিড হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে জোড়া টিকাও নেওয়া হয়ে গিয়েছে। তা হলে কি ওমিক্রনে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা কম?
দুর্ভাগ্যবশত সেটা নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না। আগে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তির পুনরায় সংক্রমিত হওয়া এবং জো়ড়া টিকা নেওয়ার পরেও তিনি ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়েছেন— এমন প্রমাণ রয়েছে। তাই এক বার কোভিড হয়ে যাওয়া বা সব জোড়া টিকা নেওয়ার পরেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
ওমিক্রনে আক্রান্তদের চিকিৎসাপদ্ধতি কি আলাদা?
ওমিক্রনের জন্য পৃথক কোনও চিকিৎসা পদ্ধতি এখনও নেই। সংক্রমণের তীব্রতা এবং রোগীর অবস্থা বুঝে চিকিৎসা করা হচ্ছে। তবে কোভিডের আগের রূপগুলির ক্ষেত্রে যে সব চিকিৎসাবিধি মানা হচ্ছিল, তাদেরই কয়েকটিকে পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে তারা ওমিক্রনের বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর।
শিশুরা কি ওমিক্রনে বেশি সংবেদনশীল?
এমনিতেই শিশুদের অসুখ কম হয়। অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের উপসর্গও দেখা যায় না। সেটাই চিন্তার কারণ হয়ে যায়। শিশুদের মধ্যে উপসর্গ বোঝা না যাওয়ায় সহজেই তারা রোগের বাহক হয়ে ওঠে। বিশেষত পরিবারের প্রবীণ এবং অসুস্থ বা কো-মর্বিডিটি আছে, এমন সদস্যদের সংক্রমিত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই ছোটদের সঠিক ভাবে কোভিডবিধি শেখানো বাড়ির বড়দের কর্তব্য। বাড়ির শারীরিক ভাবে দুর্বল সদস্যের স্বার্থে ছোটদের প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরোনো এবং ভিড় এড়িয়ে চলা উচিত।
অন্তঃসত্ত্বাদের কি করোনা টিকা নেওয়া উচিত?
অবশ্যই! প্রত্যেক অন্তঃসত্ত্বারই কোভিডের বিরুদ্ধে লড়তে জোড়া টিকা নেওয়া উচিত। কারণ, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কোভিড আক্রান্ত হলে জটিলতা কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ওমিক্রনের ভবিষ্যৎ কী?
এটা বলার সময় এখনও আসেনি। আরও দেখতে হবে। বুঝতে হবে। পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তবে মাস্কের সঠিক ব্যবহার, দ্রুত গতিতে বেশি মানুষের টিকাকরণ এবং কোভিড আক্রান্তদের চিহ্নিত করা ও তাঁদের নিভৃতবাসে রাখতে পারলে আমরা এই ভাইরাসের বিস্তার রুখতে অর্থাৎ তার ছড়িয়ে পড়ার গতি রোধ করতে পারব। কয়েক দিন আগেও শুধু বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের মধ্যেই ওমিক্রনের সন্ধান মিলছিল। এখন সেই ছবিটাও বদলাচ্ছে। আশঙ্কা, বিদেশযাত্রার ইতিহাস নেই এমন ব্যক্তিরাও এ বার আক্রান্ত হবেন। তাই সময় থাকতে থাকতেই কোভিড মোকাবিলার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে আমাদের সতর্ক হবে। এ জন্য কোভিডের ন্যূনতম উপসর্গ দেখা দিলেই নিভৃতবাসে থাকতে হবে। ভাইরাস যাতে ছড়াতে না পারে তার জন্য মাস্ক পরা অত্যন্ত জরুরি।
তিন দিন করোনার উপসর্গ থাকলে অবশ্যই কোভিড পরীক্ষা করতে হবে। গোষ্ঠী সংক্রমণ রুখতে আমাদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। কোভিড-আক্রান্তদের দ্রুত চিহ্নিত করে অন্যদের থেকে তাঁদের আলাদা রেখে ভাইরাসের শিকল ভাঙাই গোষ্ঠী সংক্রমণ রোখার অন্যতম পথ।
ওমিক্রনের এই উদ্বেগের মধ্যে রাজ্যবাসীর কাছে একটাই আবেদন, ইংরেজি বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণে ভিড় এবং উৎসব থেকে বিরত থাকুন। মাথায় রাখুন, ওমিক্রন কিন্তু কোভিডের আগের রূপগুলির থেকে অনেক বেশি সংক্রাংমক। অল্প সময়ের মধ্যেই একাধিক মানুষকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা রয়েছে ওমিক্রনের। তাই সাবধান!
(লেখক ফুসফুস-রোগ বিশেষজ্ঞ। মতামত নিজস্ব)