কুম্ভমেলা, মণিপুরের বৌদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণের ন্যায় পালিত ও আচরিত ঐতিহ্যগুলি পূর্বেই স্থান পাইয়াছিল; প্রতিবেশী বাংলাদেশের বৈশাখ-প্রারম্ভের মঙ্গল শোভাযাত্রাও। এই বার ইউনেস্কোর আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হইল কলিকাতার দুর্গাপূজা। কলিকাতা, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের জন্য তো বটেই, বিশ্বের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পক্ষেও ইহা গৌরব ও গর্বের সংযোজন। মনে রাখিতে হইবে, ইউনেস্কোর সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে বিশেষ ভাবে উল্লিখিত হইয়াছে— দুর্গাপূজা ভারতের বিভিন্ন অংশে পালিত হয় বটে, কিন্তু কলিকাতার দুর্গাপূজার কথা ভিন্ন। বাকি দেশে যাহা স্রেফ পূজা বা ধর্মজীবনের অন্যতম পালনীয় অঙ্গ, কলিকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে তাহা মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অশেষ প্রভাববিস্তারী এক সংঘটন। সাড়ম্বর ও সময়নির্দিষ্ট উদ্যাপনেই তাহার শেষ নহে, তাহার প্রভাব ও প্রসার লক্ষ লক্ষ মানুষকে জড়াইয়া থাকা জীবিকা ও অর্থনীতি, শিল্প-সাহিত্য, সর্ব ক্ষেত্রেই। শ্রেণি, গোষ্ঠী, ধর্ম, সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সকল মানুষকে বাঁধিবার এই ঐক্যসূত্রই কলিকাতার দুর্গাপূজাকে আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিশিষ্টতা দিয়াছে।
প্রশংসার বান ডাকিবারই কথা, তাহাই হইয়াছে। প্রধানমন্ত্রী টুইট করিয়া অভিনন্দন জানাইয়াছেন প্রত্যেক ভারতবাসীকে। বলিয়াছেন, কলিকাতার দুর্গাপূজার অভিজ্ঞতা সত্যই প্রতিটি মানুষের হওয়া দরকার। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও আনন্দঘন টুইটে মনে করাইয়া দিয়াছেন, দুর্গাপূজা কেবল উৎসব নহে, সমানুভূতির আবেগের সমার্থক। কথাপ্রসঙ্গে ভাসিয়া উঠিয়াছে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাম্প্রতিক অভিযোগও— এই রাজ্যে দুর্গাপূজা হয় না, বা করিতে দেওয়া হয় না। ইউনেস্কোর গৌরবময় সম্মাননা সেই অভিযোগের, বাঙালির উদারবাদী ঐতিহ্যে আঘাতের যোগ্য জবাব, এমন মত চর্চিত হইতেছে জনপরিসরে। রাজনীতির কারবারিরা রাজনৈতিক ফয়দা লুটিবার স্বার্থে দুর্গাপূজাকেও ব্যবহার করিবেন তাহা আশ্চর্য নহে, আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি কলিকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপূজার বহুবিস্তারী ও ঐক্যবাদী চরিত্রটিকে বিশ্বের দরবারে তো বটেই, দেশের মধ্যেও সুস্পষ্ট করিয়াছে বলিলে ভুল হইবে না।
তবে ঐতিহ্যের গৌরবে শুধু ভাসিলেই চলে না, তাহার দায় ও ভার স্বীকারও করিতে হয়। খেয়াল রাখিতে হয়, ঐতিহ্যের আচরণ যেন কোনও ভাবেই মানুষের অসুবিধার কারণ না হয়। এই শহরের ও রাজ্যের দুর্গাপূজায় আড়ম্বরের আতিশয্য, পৃষ্ঠপোষণার প্রাচুর্য আছে, পাশাপাশি উৎসবকালীন নাগরিক অসুবিধাও কোনও মতেই কম নহে। রাস্তা জুড়িয়া মণ্ডপ নির্মাণ, পূজার কয়দিন পথ নিয়ন্ত্রণ ও জনযানের অপ্রতুলতা, শব্দদূষণ, বিজ্ঞাপনী হোর্ডিং-ব্যানারে দৃশ্যদূষণ, নাগরিক অস্বাচ্ছন্দ্যের এ-হেন বিস্তর উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। অতিমারি-বিধি এই সব অসুবিধা খানিক কমাইয়াছে, কিন্তু নির্মূল করিতে পারে নাই। পূজার ভিড়ে ঠাসা রাস্তায় অবরুদ্ধ অ্যাম্বুল্যান্সের যাত্রী দুর্গাপূজাকে দুষিলে উৎসবেরই সুরতালভঙ্গ হয়। প্রশাসনকে বুঝিতে হইবে, ঐতিহ্যের আনন্দস্রোতে শৃঙ্খলা ভাসিয়া যাইতে পারে না। ঐতিহ্য অবশ্যই উদ্যাপিত হইবে, কিন্তু নাগরিকের অসুবিধার মূল্যে নহে। বিশ্ব-সম্মাননার এই গৌরবমুহূর্তটিতে এই সত্য মনে রাখা দরকার।