—ফাইল চিত্র
এবছর ৩১ অগস্ট অসমের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি প্রকাশিত হয়েছে। এই চূড়ান্ত তালিকায় তিন কোটি ১১ লক্ষ মানুষ স্থান পেয়েছেন। বাদ পড়েছেন ১৯ লক্ষ মানুষ। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই প্রকাশিত খসড়া তালিকা থেকে ৪০ লক্ষ মানুষের নাম বাদ গিয়েছিল। অর্থাৎ খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়া ২১ লক্ষ মানুষের নাম চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জিতে সংযোজিত হয়েছে। এই তালিকায় নাম তুলতে ব্যর্থ ১৯ লক্ষ মানুষকে ফরেনার্স ট্রাইবুনালে নাগরিকত্ব প্রমাণের আবেদন পেশ করার জন্য চার মাস সময় দেওয়া হয়েছে। সেখানেও আবেদন নাকচ হলে তাঁরা উচ্চ আদালত ও সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন, আপাতত এটাই স্থির হয়েছে।
অসমের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি আপডেট করার কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে। নাগরিকপঞ্জিকরণের নিয়ম অনুযায়ী, প্রত্যেক ব্যক্তিকে নথিপত্র পেশ করে প্রমাণ করতে হয় যে, তিনি ওই রাজ্যের অধিবাসী অথবা ভারতের নাগরিক। ২০১৫ সাল থেকে অসমের ৩ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ সেই চেষ্টাই করে চলেছেন। কিন্তু সমস্ত প্রয়াস সত্ত্বেও ১৯ লক্ষ মানুষ নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হলেন। আইনের দৃষ্টিতে ওঁরা আর অসমের অধিবাসী অথবা ভারতের নাগরিক নন। অসমে ওঁরা এত দিন অবৈধ ভাবে বাস করছিলেন। ওঁরা বিদেশি বা অনুপ্রবেশকারী। প্রচলিত ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়ে দেখা যাচ্ছে নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১১ লক্ষই হিন্দু, ৬ লক্ষ মুসলমান ও অন্য ২ লক্ষ। নাগরিকপঞ্জিকরণের প্রক্রিয়ায় বিদেশি হয়ে পড়া মানুষগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশই বাংলাভাষী তথা বাঙালি।
গত বছরের খসড়া তালিকার মতো সদ্য প্রকাশিত চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জিও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। এই তালিকায় অসংখ্য অসঙ্গতি ও ভুল রয়েছে। এমন অনেক মানুষের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে যাঁদের পরিচয় নিয়ে কোনও সংশয় নেই। দু’-তিনটি উদাহরণ থেকেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যায়। ভারতের পঞ্চম রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলী আহমেদ ছিলেন অসমিয়া। দেশের সাংবিধানিক প্রধান থাকাকালীন তিনি প্রয়াত হন। সেই ফকরুদ্দিন সাহেবের পরিবারের সদস্যদের নাম চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জিতে অনুপস্থিত। উল্লেখ্য খসড়া তালিকাতেও তাঁদের নাম ছিল না। নিয়ম মেনে তাঁরা পুনরায় নথিপত্র পেশ করেছিলেন। কিন্তু এ বারও তালিকাভুক্ত হতে পারেননি। এর কী ব্যাখ্যা হতে পারে!
প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার সানাউল্লার ক্ষেত্রেও। খসড়া তালিকার পরে চূড়ান্ত তালিকা থেকেও কারগিল যুদ্ধে যোগ দেওয়া এই সেনা অফিসারের নাম বাদ পড়েছে। ফরেনার্স ট্রাইবুনাল তাঁকে ‘বিদেশি’ বলে ঘোষণা করেছে এবং তিনি কিছুদিন ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দিও থাকেন। পরিবার-সহ আবার তিনি ‘নিজভূমে পরবাসী’ হয়ে গেলেন। অসমের বিরোধী দলনেতা অনন্তকুমার মালো নাগরিকপঞ্জিতে জায়গা পাননি। আরও অনেক বর্তমান ও প্রাক্তন জনপ্রতিনিধি, রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের আধিকারিক এবং বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম পঞ্জিভুক্ত হয়নি। এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, অসমের জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বিচিত্র ভুলে ভরা। এই ত্রুটিপূর্ণ তালিকাকে কখনওই মান্যতা দেওয়া উচিত নয়। তালিকা প্রস্তুতকারকদের ভুলে লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন-যন্ত্রণা ভোগ করবেন কেন? ভারতের মতো একটা সভ্য রাষ্ট্রের কর্ণধারদের অবশ্যই বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত।
আমাদের একটা বহুল প্রচলিত ধারণা হল, পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশ থেকে বহু মুসলমান রুটি-রুজির সন্ধানে বিভিন্ন সময়ে এ দেশের অসম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন এবং ওঁরা আর ফিরে যান না। তাঁদেরকেই অনুপ্রবেশকারী বলা হচ্ছে। পূর্ববঙ্গের ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুরাও অবশ্য এ সব রাজ্যে আসেন। তবে তাঁরা শরণার্থী হিসেবে স্বাগত। তাঁদের নিয়ে কোনও আপত্তি নেই। যত সমস্যা ঘুসপেটিয়া মুসলমানদের নিয়ে। এই মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের নতুন ও পুরনো প্রজন্মকে চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি প্রদান করার উদ্দেশ্যেই নাগরিকপঞ্জিকরণের কর্মসূচি। কিন্তু প্রশ্ন হল, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, কেন্দ্র-রাজ্যের পুলিশ কিংবা রাষ্ট্রের সাধারণ প্রশাসন ওই অনুপ্রবেশকারীদের ধরতে পারছে না কেন? আসলে লক্ষ লক্ষ মুসলমান বাংলাদেশ থেকে গোপনে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঢুকে পড়েছে, এই ধারণার মধ্যেই
গলদ রয়েছে।
স্বাধীনতার সময় ভারতের মতো বাংলাও ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়। মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গ যায় পাকিস্তানে আর হিন্দু প্রধান পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। দুই বাংলার ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিষয়সম্পত্তি ফেলে দিয়ে দেশত্যাগ করেন এবং পাশ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নেন। তা হলে পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগুরু মুসলমানরা সংখ্যালঘুর জীবন যন্ত্রণা ভোগ করার জন্য অসম কিংবা পশ্চিমবঙ্গে আসবেন কেন? রুটি রুজির সন্ধানে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশির এ দেশে আসার কথাও যুক্তিগ্রাহ্য নয়। বাংলাদেশ অবশ্যই একটা উন্নয়নশীল বা দরিদ্র রাষ্ট্র। কিন্তু ভারতের অসম, ত্রিপুরা কিংবা পশ্চিমবঙ্গও কোনও দিন সম্পদশালী রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল না। এই রাজ্যগুলোতে অনাহারে মানুষ মরার দৃষ্টান্ত বিরল নয়, বরাবর বেকার সমস্যা তীব্র ভাবে অনুভূত হয়েছে এবং ব্যবসা বাণিজ্যের পর্যাপ্ত প্রসার ঘটেনি। তা হলে কিসের আকর্ষণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পূর্ববঙ্গের মানুষ পশ্চিমবঙ্গ অথবা অসমে আসবেন?
আসলে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ, উগ্ৰ জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক অভিসন্ধি দীর্ঘ দিন ধরে অনুপ্রবেশের বিষয়টিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখিয়ে এসেছে। অথচ অসম কিংবা পশ্চিমবঙ্গের কোনও এলাকায় আদি বা পুরনো বাসিন্দারা তথাকথিত অনুপ্রবেশকারীদের জন্য বিপন্ন হয়ে পড়েছেন বলে কোনও দিন শোনা যায়নি। ‘বৈধ’ ও ‘অবৈধ’ ভাবে বসবাসকারী মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী বিবাদে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়নি। অনুপ্রবেশকারীদের উপদ্রবে দেশের কোথাও অশান্তি সৃষ্টির খবর নেই। কেবল কিছু দল ও সংগঠন তাদের কায়েমি স্বার্থে অনুপ্রবেশ নিয়ে অযথা অপপ্রচার করে চলেছে।
ভারতের মতো বিশাল আয়তন ও জনসংখ্যার দেশে নাগরিকপঞ্জিকরণ একটি অবাস্তব ও অপ্রয়োজনীয় আয়োজন। দেশের কোটি কোটি মানুষকে নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে বলার মধ্যেই একটা বোকামি ও বদমায়েশি রয়েছে। কথায় আছে, চেনা ব্রাহ্মণের পৈতে লাগে না। যাকে সবাই চেনে তার আবার পরিচয়পত্রের কী দরকার? অথচ নাগরিকপঞ্জিকরণে সেটাই করা হয়েছে। নথি না থাকলেই বলে দেওয়া হয়েছে, তুমি নাগরিক নও। সবার উপরে নথি সত্য, তাহার উপরে নাই। এ জন্য অসমের সমস্ত মানুষ অন্য কাজকর্ম ছেড়ে শুধু নথি সংগ্ৰহে ব্যস্ত থেকেছেন। তাঁরা বাধ্য হয়েছেন নাগরিকপঞ্জিতে নাম ওঠানোর জন্য বছরভর ছোটাছুটি করতে। সরকারি কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। এই (অ)কাজের জন্য পঞ্চাশ হাজার কর্মী নিযুক্ত হয়েছেন। আজকের জেট গতি ও গ্লোবাল ভিলেজের যুগে মান্ধাতা আমলের নথির মাধ্যমে বসবাসের প্রমাণ দাখিল করার কথা পশ্চাদপদ চিন্তাভাবনা থেকেই আসা সম্ভব। অসমে এনআরসি-র ভয়াবহ পরিণতির পরেও পশ্চিমবঙ্গ-সহ আরও কয়েকটি রাজ্যে এই প্রক্রিয়া শুরুর আয়োজন সত্যিই আশঙ্কাজনক।
(মতামত ব্যক্তিগত)
প্রধান শিক্ষক, কাবিলপুর হাইস্কুল