মনোযোগী। নেতাজি ভবনে প্রধানমন্ত্রী নেহরু; সঙ্গে শিশির কুমার বসু ও বালক সুগত বসু। ১৯৬১
নেতাজি ভবনে শ্রদ্ধা জানাতে, নেতাজি মিউজিয়ম দেখতে দেশ-বিদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও অন্যান্য বিশিষ্ট জনের আনাগোনা লেগেই থাকে। একটা অলিখিত বিধি আছে— তাঁদের ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয় না। তাঁরাই ফুল দেন নেতাজির শয়ন কক্ষে অথবা ইত্তেফাক, ইতমদ্, কুরবানি লেখা শহিদ স্তম্ভের পাদদেশে। একেবারে গোড়ার দিকে এক বার এই প্রথা ভাঙা হয়েছিল। অথবা হয়তো বিধি তখনও প্রচলিত হয়নি। ১৯৬১ সাল। নেতাজি ভবন পরিদর্শন করতে এলেন প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজির সহযোদ্ধা জওহরলাল নেহরু। পরিবারের শিশুকন্যার হাত দিয়ে তাঁকে এক গুচ্ছ গোলাপ ফুল দেওয়া হল। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে কড়া নির্দেশ, পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে সব কিছু দেখিয়ে ওঁকে ছেড়ে দিতে হবে। আমার বেশ মনে আছে, প্রতিটি ছবির সামনে নেহরু কুড়ি মিনিট করে দাঁড়িয়ে আছেন। গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। আমরা কী করে তাঁকে তাড়া দেব! ছবি দেখার ফাঁকে শিশিরকুমার ও নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর সদস্যদের তিনি উৎসাহ দিচ্ছেন। ‘সুভাষের সম্পর্কে সব দলিলপত্র তোমরা এখানে সংগ্রহ করার চেষ্টা করো’, বলছেন। বিদেশ মন্ত্রক তাঁর হাতে। বলছেন, ‘আমি নির্দেশ দিয়ে দেব, বিদেশে ছড়িয়ে আছে সুভাষের কার্যকলাপের যা কিছু, তা যেন এখানে রক্ষিত হয়।’ এরই মধ্যে শরৎচন্দ্র বসুর পরিবারের কাউকে দেখতে পেলে সাদর সম্ভাষণ করছেন। আমার ননদিিন, শরৎচন্দ্র বসুর কন্যাদের জড়িয়ে ধরলেন, চুমু খেলেন। বাড়ির সব ছোটদের আদর করলেন। আমার বালকপুত্র সুগত ওঁর পায়ে পায়ে হেঁটে যথেষ্ট বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। উনি অসুবিধা বোধ করা দূরস্থান, মাঝে মাঝেই গাল টিপে দিচ্ছেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
এই যে ছবিটি আমার মনের মধ্যে আছে তা প্রবল ধাক্কা খেল, যখন আমি জানতে পারলাম ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতার পর কুড়ি বছর ধরে জওহরলাল নেহরুর (ও তঁার উত্তরসূরিদের) সরকার আমার স্বামী ডাক্তার শিশির কুমার বসু এবং আমার ভাসুর অমিয়নাথ বসু, এই বসুভ্রাতাদের ওপর নজরদারি চালু রেখেছিল! উডবার্ন পার্কের বাড়ি এবং এলগিন রোডে নেতাজি ভবন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক পীঠস্থান। এই দুই বাড়ির ওপর দিল্লির উচ্চতম গোয়েন্দা সংস্থা প্রখর দৃষ্টি রেখেছে। ব্রিটিশ আমলে শরৎ-সুভাষের প্রতি এই আচরণ করার একটা অর্থ ছিল। এই প্রজন্মের বসুভ্রাতারা কেন সন্দেহভাজন, তা বোধগম্য নয়।
সাদাত হাসান মান্টো একটি শব্দবন্ধ অনেক বার ব্যবহার করেছেন: ‘দুশমন দোস্ত’। এর অর্থ বন্ধুর ছদ্মবেশে শত্রু। ফাইলবন্দি এই গোয়েন্দাগিরি প্রকাশ্যে আসার পর যে ভাবে খবর পরিবেশিত হচ্ছে, যথা when Nehru spied on Netaji— তাতে জওহরলাল নেহরুকে ‘দুশমন দোস্ত’-এর ভূমিকায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনও ইতিহাসবিদ বা প্রকৃত গবেষক বিনা বিচারে এই তত্ত্ব গ্রহণ করবেন না। দুটি মানুষের সম্পর্ক, বিশেষত যেখানে দুজনেই বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, তার বিশ্লেষণ করতে হবে তাঁদের সারা জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে। জনসেবক হিসেবে তাঁরা যখন এক সঙ্গে কাজ করেছেন, তার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সেখানে ব্যক্তিজীবনে দেখি গভীর বন্ধুত্ব, রাজনীতিতে মতাদর্শের মিল, দুজনেই বামপন্থার কথা, সমাজতন্ত্রের কথা বলছেন, দুজনেই আন্তর্জাতিক দৃষ্টিসম্পন্ন। বাধা কোথায়?
দুজনেই গাঁধীজির নেতৃত্বে কাজ করতেন। কিন্তু মতের অমিল হলে নেতাজি বিদ্রোহ করতেন আর নেহরু প্রথমে তর্জনগর্জন করে গাঁধীজির কাছে নতজানু হতেন। নেতাজি তো লিখেই জানিয়েছেন, ‘my knee shall bend only to God.’ আর স্পষ্ট বলেছেন, ‘my conscience is my own.’
ত্রিশের দশকে নেতাজির ইউরোপে নির্বাসিত জীবনের উপর আমি এক সময়ে কিছু কাজ করেছিলাম। তখনও নেতাজির সব পত্রাবলি প্রকাশিত হয়নি। নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো’তে রক্ষিত ওই সময়ের চিঠিপত্র পড়ে আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম ইউরোপের স্যানাটোরিয়ামে অসুস্থ কমলা নেহরুর জন্য সুভাষচন্দ্র কত উদ্বিগ্ন। জওহরলাল তখন দেশে কারাগারে বন্দি। সুভাষচন্দ্র নিজে ভিয়েনাতে গল ব্লাডার অপারেশনের পর ধীরে ধীরে ভাল হচ্ছেন। দুর্বল শরীরে কার্লসবাদ যাবেন। ভিয়েনা থেকে প্রাগ সঙ্গে নিয়ে চলেছেন গুরুতর অসুস্থ কমলা নেহরুকে। প্রাগ থেকে ডাঃ কাটিয়ারের সঙ্গে কমলা গেলেন তাঁর জার্মানির স্যানাটোরিয়াম। আর সুভাষচন্দ্র, কার্লসবাদে শরীর সারাতে। ডাক্তারের পরামর্শে সুভাষ হফ্গাস্টাইন যাবেন, ঘুরপথে বাডেনওইলার হাজির হলেন। কমলার অবনতি হয়েছে। ব্রিটিশ সরকার মুক্তি দিয়েছে নেহরুকে। দুই বন্ধু একই বোর্ডিং হাউসে থাকছেন। কমলার সামান্য উন্নতি দেখে সুভাষ হফ্গাস্টাইন চলে গেলেন। দরকার পড়লেই যেন নেহরু ডেকে পাঠান। সুভাষচন্দ্র তাঁর বান্ধবী নাওমি ফেতারকে (Naomi Vetter) লেখা চিঠিপত্রে এ সব খবর দিচ্ছেন। পরে দেখেছি এমিলিয়ে শেংকল’কে লেখা চিঠিতেও আছে এ সব কথা।
অক্টোবর ১৯৩৫। আবার হফ্গাস্টাইন থেকে ফিরতি পথে নেহরু ও কমলার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। মৃত্যুর সময়ে কমলা রয়েছেন লসানে (Lausanne)। সুভাষ এসে পৌঁছলেন ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬। ২৮শে মারা গেলেন কমলা। তখন পাশে আছেন জওহরলাল, কন্যা ইন্দিরা এবং সুভাষচন্দ্র। অন্ত্যেষ্টির আয়োজনে ব্যস্ত হলেন সুভাষ। এই সমগ্র পর্বটি আমার অত্যন্ত মর্মস্পর্শী মনে হয়েছিল। আমি ইন্দিরা গাঁধীকে চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলাম এই সময়ে সুভাষ ও জওহরলালের কোনও কথোপকথন তাঁর মনে পড়ে কিনা। জবাবে ইন্দিরা বলেছিলেন: আমার মায়ের মৃত্যুর একেবারে শেষ সময়ে আমি এসে পৌঁছলাম, আমার মনের অবস্থা কেমন ছিল বুঝতেই পারো। ইন্দিরা জানান যে দুজনের সম্পর্ক বা আলাপ-আলোচনার কথা তেমন ভাবে তাঁর মনে নেই। সে সময়ের চিঠিপত্র দেখলে বোঝা যায় এই শোকের সময়ে দুজনে মানসিক ভাবে খুব কাছাকাছি ছিলেন। দেশে ফিরে গিয়ে লখনউ কংগ্রেসে সভাপতির কাজ ভাল করে করতে হবে— সুভাষচন্দ্র বলছেন নেহরুকে।
বন্ধুবিচ্ছেদ ঘটে গেল ত্রিপুরি কংগ্রেসের সময়ে ১৯৩৯ সালে। গাঁধীজির বিরোধিতা সত্ত্বেও নির্বাচনে জয়ী হয়ে সুভাষচন্দ্র দ্বিতীয় বার কংগ্রেস সভাপতি। এই ঘটনায় গাঁধীজি স্বয়ং এবং কংগ্রেসের গাঁধীবাদী দক্ষিণপন্থী নেতৃবৃন্দ ক্রুদ্ধ। গোবিন্দবল্লভ পন্থ তাঁর কুখ্যাত পন্থ প্রস্তাব পাশ করিয়ে এমন ভাবে নবনির্বাচিত সভাপতির হাত বেঁধে দিলেন যে তাঁর পক্ষে ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা অসম্ভব হয়ে পড়ল। গাঁধীজির সম্মতি থাকতে হবে এ দিকে তিনি সুভাষের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসহযোগিতা করলেন।
সুভাষচন্দ্রের জীবনের এই ঘোর রাজনৈতিক সংকটের সময়ে তাঁর মেজদাদা শরৎচন্দ্র বসু ছাড়া আর এক জন তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ। এই দুঃসময়ে তিনি ‘দেশনায়ক’ বলে বরণ করলেন সুভাষকে। জওহরলাল নেহরু ঠিক কোন দিকে ছিলেন বন্ধুর এই বিপদে? তিনি পুরোপুরি গোবিন্দবল্লভ পন্থ ও তাঁর দলের সঙ্গে নেই। একটু আলাদা থাকার চেষ্টা করছেন কিন্তু সুভাষের পাশেও প্রকাশ্যে নেই।
এই সময়ে নেতাজির নেহরুকে লেখা বিখ্যাত সাতাশ পাতা টাইপ করা চিঠি। সেখানে তিনি নির্মম ভাবে আক্রমণ করেছেন নেহরুর দোলাচল মনোভাবকে। কোনও সংকটের সময় তুমি মন ঠিক করতে পারো না, দুই নৌকোতে পা দিয়ে চলো। ইংরেজিতে বললেন, রাইডিং টু হর্সেস। অথচ সুভাষচন্দ্র তাঁকে বড় ভাইয়ের মতো দেখেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন সব কাজে। ২৯ মার্চ লেখা এই চিঠির জবাব দিলেন নেহরু ৩ এপ্রিল। নিজস্ব ভঙ্গিতে তিনি স্বীকার করে নিলেন নিজের চরিত্রের দুর্বলতা। তিনিও কনিষ্ঠকে অত্যন্ত স্নেহ করেন, যদিও তার কাজকর্মের ধরন কখনও কখনও ওঁর অপছন্দ। এই চিঠিচাপাটির পরেও জামডোবা থেকে অসুস্থ সুভাষচন্দ্র লিখছেন, তুমি কী এক বার এখানে আসতে পারবে? গাঁধীজিকে কী ভাবে বোঝানো যায় পরামর্শ করতাম। জওহরলাল বললেন, তুমি ডাকলে আমি কি না গিয়ে পারি? এর পরই দেখতে পাচ্ছি জওহরলাল চিঠি লিখছেন গাঁধীজিকে। সুভাষকে মেনে নিতে অনুরোধ করছেন তিনি। কিন্তু মহাত্মার দিক থেকে কোনও উদারতার আশ্বাস নেই, তিনি অন়ড়।
দেশত্যাগ করে যাওয়ার পর জার্মানি ও জাপানের সাহায্য নিয়ে মুক্তি ফৌজ গড়ে তুললেন সুভাষ বসু। সিঙ্গাপুরে প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী স্বাধীন ভারত সরকারের তিনি রাষ্ট্রপ্রধান। পঁয়তাল্লিশ হাজার সৈনিক নিয়ে গঠিত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সেনাপ্রধানও তিনি। সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্ব এক অন্য স্তরে উত্তীর্ণ। মহাত্মা গাঁধীর পাশাপাশি বিকল্প নেতৃত্বে নাম উঠে আসছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর। গাঁধীজির অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সৈনিক ছিলেন, কারাবরণ করেছেন এগারো বার। এ দিকে তিনিই একমাত্র রাষ্ট্রনেতা যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন। ভারতের স্বাধীনতা যখন এল, সুভাষচন্দ্র তখন অনুপস্থিত। তিনি পরিণত হয়েছেন লেজেন্ড-এ। অপর দিকে গাঁধীজির মনোনীত উত্তরাধিকারী হিসেবে জওহরলাল স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন। এক অদৃশ্য মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তির সঙ্গে যেন নেহরুকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে। ভারতের সাধারণ মানুষের কাছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র এক অপূর্ণ আশার প্রতীক, যদি তিনি ফিরে আসতেন দেশের ইতিহাস অন্যরকম হত, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ তিনি প্রতিরোধ করতেন। সাধারণ মানুষের দারিদ্র, দুঃখকষ্ট তিনি দূর করতেন: সমগ্র ব্যাপারটা একটা মনস্তাত্ত্বিক পর্যায়ে চলে গেল। মানুষ তাঁর মৃত্যুসংবাদ বিশ্বাস করতে প্রস্তুত নয়। ১৯৫৬ সালের কমিশনে বিমান দুর্ঘটনার পর জীবিত সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিয়ে গিয়েছেন। নেহরু সরকার সেই কমিশনের রিপোর্ট গ্রহণও করেছেন।
বসু ভ্রাতৃদ্বয়ের ওপর নজরদারির যে ফাইল প্রকাশ্যে এসেছে, তার মধ্যে এমন প্রমাণ নেই যে জওহরলালের নির্দেশে এই কাজ চলছিল। কিন্তু যে উচ্চতম পর্যায়ে এই কাজ হচ্ছে তা প্রধানমন্ত্রী দফতর বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অগোচরে হওয়া সম্ভব নয়। ১৯৫০ সালে সর্দার বল্লভভাই পটেলের মৃত্যুর পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে যাঁরা থেকেছেন তাঁদের মধ্যে গোবিন্দবল্লভ পন্থ অন্যতম। কলকাতায় এলগিন রোডের পোস্ট অফিসে চিঠি খুলে পড়া হচ্ছে, ১৩ নম্বর লর্ড সিন্হা রোডের অফিস থেকে নজরদারি চলছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। ভারত সরকার কী যেন এক আশঙ্কায় ভুগছেন। শিশির বসু কেন নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো প্রতিষ্ঠা করেছেন, কেন সেখানে আইএনএ-র প্রাক্তন অফিসাররা একত্র হচ্ছেন, কেনই বা শিশির বসু তাইপে গিয়ে নেতাজির খোঁজখবর করছেন, খুবই গভীর সন্দেহের বিষয়। অমিয় বসুকে লেখা চিঠি ইংল্যান্ডের গোয়েন্দাদের সঙ্গে শেয়ার করছেন তাঁরা। আজকাল জঙ্গিদের কার্যকলাপ বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দারা পরস্পরের সঙ্গে আদানপ্রদান করেন। কিন্তু এই পরিবার তো জঙ্গি নয়!
সত্য উদ্ঘাটিত হোক। গোপনীয়তা কেবল জন্ম দেয় গুজব ও কল্পকাহিিনর।