Parliament

ধর তক্তা, মার পেরেক

আলোচনা দূরস্থান, কোন প্রস্তাবে কাহার সম্মতি আছে এবং কাহার নাই, সেই ন্যূনতম তথ্যটুকুও সুষ্ঠু ভাবে নথিভুক্ত করিবার সুযোগ মিলিল না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০২:২৪
Share:

ছবি পিটিআই।

কথা ছিল, অতিমারির কারণে সংসদের সংক্ষিপ্ত বাদল অধিবেশন চলিবে আঠারো দিন। কুরুক্ষেত্রের আদর্শ মনে রাখিয়াই হয়তো সেই নির্ঘণ্ট স্থির হয়। তবে, শেষ পর্যন্ত আঠারো অবধি গড়ায় নাই, দশ দিনেই বাদলধারা সারা হইয়াছে। এহ বাহ্য। দুই দশকের হ্রস্বতম অধিবেশনে দুই ডজনের বেশি বিল পাশ হইয়াছে, অর্থাৎ উৎপাদনশীলতার বিচারেও এই পর্বটি ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে গভীর দাগ রাখিয়া গেল। প্রধানমন্ত্রী বলিতে পারেন: ন্যূনতম কাল, সর্বাধিক কাজ। তক্তা ধরিয়া পেরেক মারিবার বিধান যদি গণ্য এবং মান্য হয়, তবে অস্বীকার করিবার উপায় নাই— ভারতীয় গণতন্ত্র অতিমাত্রায় কর্মঠ ও ফলপ্রসূ হইয়া উঠিয়াছে। মহাভারতও হার মানিয়াছে।

Advertisement

কিন্তু সংসদীয় বিতর্ক? প্রস্তাবিত আইন লইয়া, সেই আইন-প্রস্তাবের সামগ্রিক প্রতিপাদ্য, এবং সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় লইয়া জনপ্রতিনিধিরা তাঁহাদের বিভিন্ন অবস্থান হইতে নিজস্ব মতামত বলিবেন, শুনিবেন, বিচার করিবেন, সেই সচেতন বিনিময়ের মাধ্যমে আপন চিন্তা ও মতকেও ক্রমাগত যাচাই করিবেন এবং তথ্য ও যুক্তির এই সমবেত অনুশীলনের পথে আইনসভা তাহার সিদ্ধান্ত স্থির করিবে— যথার্থ বিতর্কের এমন অনুষ্ঠানই তো গণতন্ত্রের ধর্ম। গত সপ্তাহে ভারতীয় সংসদে যে পদ্ধতিতে বিলের পরে বিল পাশ করানো হইয়াছে, তাহা সেই ধর্ম হইতে সম্পূর্ণ বিচ্যুত। আলোচনা দূরস্থান, কোন প্রস্তাবে কাহার সম্মতি আছে এবং কাহার নাই, সেই ন্যূনতম তথ্যটুকুও সুষ্ঠু ভাবে নথিভুক্ত করিবার সুযোগ মিলিল না। কখনও ধ্বনি ভোটে, কখনও বা বিরোধী দলের সদস্যদের অনুপস্থিতিতে মত-অমত যাচাইয়ের প্রাথমিক শর্তও পূর্ণ হইল না। শাসকরা গলার জোরে অথবা বিরোধী-শূন্য কক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আইন পাশ করাইতেছেন— এই দৃশ্য দেশ ও দুনিয়ার মানুষকে দেখাইয়া দিল, সংখ্যাগুরুবাদের কী নিদারুণ মূর্তি আপনাকে গণতন্ত্র বলিয়া কায়েম করিয়াছে। শাসকরা তক্তা ধরিলেন, পেরেক মারিলেন, সেই প্রচণ্ড তৎপরতায় গণতন্ত্রের আদর্শও পপাত চ, মমার চ।

মানিতেই হইবে, এই পরিণতি আকস্মিক নহে। সংসদীয় গণতন্ত্রের মৌলিক আদর্শকে তুচ্ছ করিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এবং সেই জোর যথেষ্ট না হইলে ছলে বলে কৌশলে শাসকের মত চাপাইয়া দিবার অনাচার এই দেশে অনেক দিন ধরিয়াই প্রচলিত হইয়াছে, অতীতেও কিছু কিছু সময়ে তাহার মাত্রা চড়িয়াছে। সংসদের সামগ্রিক পরিবেশের অবক্ষয় লইয়া তৎকালীন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষুব্ধ তিরস্কারের পরে এক যুগেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত। তাহাতে পরিস্থিতি পাল্টাইয়াছিল, তেমন দাবি করা মুশকিল। কিন্তু বর্তমান জমানায় প্রতিবাদ ও বিরোধিতাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিবার যে নিরাবরণ রীতি ক্রমাগত অনুসৃত হইতে হইতে কার্যত ‘স্বাভাবিক’ হইয়া গিয়াছে, তাহাকে অভিনব বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। সরকারের কথায় বা কাজে প্রতিবাদ করিলেই সেই বিরোধিতাকে রাষ্ট্রদ্রোহের তকমা দিবার যে উদগ্র আধিপত্যবাদ এই শাসকদের আচরণে প্রকট, সংসদে তাহারই প্রতিফলন ঘটিয়া চলিয়াছে। যে ভাবে হউক, বিল পাশ করানো হইবে, বিরোধীরা সংসদের কক্ষে উপস্থিত না থাকিলে আরও ভাল— এই মানসিকতা গণতন্ত্রের বিপরীত মেরুতে অধিষ্ঠিত। আশঙ্কা হয়, অতিমারির দুর্দিন কাটিয়া যাইবার পরেও শাসকরা এই রীতিই অনুসরণ করিতে তৎপর হইবেন, ঝড়ের বেগে বিবিধ আইন পাশ করাইয়া সংসদের উৎপাদনশীলতায় গৈরিক বিপ্লবের নবযুগ আনিয়া অমিত সাফল্যের বড়াই করিবেন। বিরোধীদের বহিষ্কার করিয়া অথবা অপমানপূর্বক বয়কটে বাধ্য করিয়া যদি সেই সাফল্য সহজতর করা যায়, অন্ধ পেচক আসিয়া তাহার তুমুল গাঢ় সমাচার জানাইয়া বলিবে: ধরা যাক দু’-একটি ইঁদুর এবার।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement