—ফাইল চিত্র।
একেবারেই গ্রহ-নক্ষত্রের কৃপাদৃষ্টি। না হলে তামিলনাড়ুর ছোট্ট শহরে বড় হওয়া, সাধারণ পরিবারের মেয়ের হাতে এত ‘গুরুদায়িত্ব’ এসে পড়ে! নির্মলা সীতারামন নিজে প্রায়ই বলেন, ‘কসমিক গ্রেস’ বা গ্রহ-নক্ষত্রের কৃপাদৃষ্টি ছাড়া এটা অসম্ভব।
তিনি দেশের অর্থমন্ত্রী। তা-ও নরেন্দ্র মোদী সরকারের অর্থমন্ত্রী। যে প্রধানমন্ত্রী টিভি-র পর্দায় ঘোষণা করে দেন, ‘আসিতেছে, আসিতেছে’, ২০ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক দাওয়াই আসছে, আর তার পরে টানা পাঁচ দিন ধরে অর্থমন্ত্রীকে সাংবাদিক সম্মেলন করে সেই বিশ লক্ষ কোটি টাকার ফিরিস্তি দিতে হয়। শেষবেলায় যোগ করে দেখাতে হয়, সত্যিই দাওয়াইয়ের মূল্য ২০ লক্ষ কোটি টাকা। নিন্দুকেরা বললেন, প্রধানমন্ত্রীর হিসেবে যে কোনও জল মেশানো নেই, সেটাই নির্মলাকে প্রাণপাত করে প্রমাণ করতে হল।
আসলে নির্মলা সীতারামনের গ্রহ-নক্ষত্র তাঁর প্রতি কখন সদয় হয়, কখন নির্দয় হয়, বোঝা মুশকিল। মোদী সরকারের একেবারে শীর্ষস্তরে নির্মলার প্রথমে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, তার পরে অর্থ মন্ত্রকের গুরুদায়িত্ব পাওয়া যেমন একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল, তেমনই দুই মন্ত্রকের দায়িত্ব পাওয়ার পরেই কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়েছে।
নির্মলা প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পাওয়ার পরেই রাফাল চুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। নির্মলা যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তির সময় প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন না। কিন্তু তাঁর উপরেই দায়িত্ব বর্তায় দুর্নীতি হয়নি প্রমাণ করার। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তির গোপন ফাইল সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়। এই সব দেখেশুনেই অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব নিয়ে তিনি নর্থ ব্লকে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন।
কিন্তু অর্থ মন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়েও ভাগ্য তাঁর প্রতি সুপ্রসন্ন হয়নি। অর্থমন্ত্রী হওয়ার দিনেই আর্থিক বৃদ্ধির হার পাঁচ বছরে সব থেকে তলানিতে নেমেছিল। তার পরেও অর্থনীতির শ্লথ গতি বজায় থেকেছে। আর এখন করোনা-সঙ্কট ও লকডাউনের ধাক্কায় অর্থনীতি ভূপতিত। তাঁর বিশ লক্ষ কোটি টাকার বটিকা কতখানি কাজ করবে, তা নিয়ে ঘোর সন্দেহ। কিন্তু নির্মলা এই দাওয়াইয়ের পক্ষে জোরালো সওয়াল করে চলেছেন।
ইংরেজিতে বলিয়ে-কইয়ে নির্মলার এই লড়াকু সওয়াল করাটাই তাঁর রাজনীতিতে উত্থানের চাবিকাঠি। না হলে মন্ত্রিসভা কেন, বিজেপি-র শীর্ষস্তরেই তিনি মূর্তিমতী ‘মিসফিট’। বিজেপির হিন্দি বলয়ের দাপুটে নেতাদের পাশে তামিল আয়েঙ্গার পরিবারের কন্যা নির্মলা ভাল করে হিন্দি বলতে পারেন না। সঙ্ঘ পরিবারেও তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষা হয়নি। তাঁর রাজনীতির হাতেখড়ি দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। অর্থনীতিতে এমএ পড়তে এসে। না, এসএফআই বা বাম রাজনীতি তিনি করেননি। উল্টে তিনি যোগ দিয়েছিলেন ‘ফ্রি থিঙ্কার্স’ নামের যুক্তিবাদী, না ডান, না বাম ছাত্র সংগঠনে। সঙ্ঘ পরিবারের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-তেও কস্মিনকালে নাম লেখাননি।
তার পরেও কেন বিজেপি-তে যোগ দিয়েছিলেন? নির্মলা যুক্তি দেন, বিজেপি তাঁকে সমাজের জন্য কাজ করার মঞ্চ দিয়েছে। আসলে বিজেপিরও ২০১৪-র ভোটের আগে ইংরেজিতে বলিয়ে-কইয়ে, মহিলা, শহুরে মুখের মুখপাত্র দরকার ছিল। নরেন্দ্র মোদীর গুজরাত মডেল-এর হয়ে জোরালো সওয়াল তাঁকে শীর্ষনেতৃত্বের নেকনজরে নিয়ে আসে। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে তাঁকে বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী করা হয়।
তখনও অবশ্য কেউ ভাবেননি, নির্মলা কোনও দিন স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, অর্থ ও বিদেশ মন্ত্রকের ‘বিগ ফোর’-এ ঢুকে পড়বেন। মনোহর পর্রীকরের জায়গায় নির্মলাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ার জন্য অরুণ জেটলি না কি জোরালো সুপারিশ করেছিলেন। আবার জেটলি অসুস্থ হয়ে পড়ায় পীযূষ গয়াল অর্থমন্ত্রী হবেন বলে যখন সকলে নিশ্চিত, তখনও নাকি পীযূষকে আটকাতেই বিজেপির কিছু নেতা নির্মলার নাম সুপারিশ করেন। নির্মলাকে নাম-কা-ওয়াস্তে অর্থমন্ত্রী করে আসলে পিএমও-র পক্ষে অর্থ মন্ত্রক চালানো সহজ। যেমন দুষ্টু লোকে বলে, নির্মলা প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকার সময়ও আসল সিদ্ধান্ত নিতেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল।
বিয়ের পর অর্থনীতিতে পিএইচডি-র কাজ শেষ না করেই নির্মলা স্বামীর সঙ্গে লন্ডনে চলে গিয়েছিলেন। হ্যাবিট্যাট-এ সেলসগার্লের কাজ করেছেন। বড়দিনের সময় রেকর্ড বিক্রির জন্য শ্যাম্পেন পুরস্কার পেয়েছেন। আবার প্রাইস ওয়াটারহাউস, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসেও কাজ করেছেন। তাঁর হাতে ক্ষমতা যতটুকুই থাক, একটা ক্ষমতা তাঁর বিরাট। নির্মলা দারুণ ‘টাস্কমাস্টার’। নরমে-গরমে সময়সীমার মধ্যে কাজ করিয়ে নিতে তাঁর জুড়ি নেই।