—ফাইল চিত্র।
অর্থমন্ত্রীর তৃতীয় দফা প্যাকেজেও মানুষের হাতে টাকার ব্যবস্থা করিবার কথা নাই— ভবিষ্যতে থাকিবে, তেমন কোনও ভরসাও তাঁহারা দেন নাই। রাষ্ট্রপুঞ্জ যাহাই বলুক, প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদরা যে পরামর্শই দিন, ভারতের শাসকরা নিজেদের প্রজ্ঞায় অটল— তাঁহাদের হাত গলিয়া কড়িটি পড়িবে না। ইতিমধ্যেই সরকারি অলিন্দে একটি রব উঠিয়াছে যে, অর্থব্যবস্থার চাকা যখন ফের ঘুরিতে আরম্ভ করিয়াছে, তখন আর মানুষের হাতে নগদ টাকার ব্যবস্থা করিবার কী প্রয়োজন? প্রাথমিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচ করিবার সামর্থ্য সমাজের যে শ্রেণিটির হাতে থাকে, সেই মধ্যবিত্ত ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর আয় বাজার গতিশীল হইলে বাড়িবে, ফলে চাহিদাও ফিরিয়া আসিবে। অন্তত, অর্থনীতির সরকারি প্রজ্ঞা তেমনই বলিতেছে। সমস্যা হইল, গত ছয় বৎসরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা অর্থমন্ত্রীরা এমন কোনও দৃষ্টান্ত স্থাপন করিতে পারেন নাই, যাহাতে দেশবাসী আশ্বস্ত হইতে পারেন যে, তাঁহাদের অর্থনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান বা ন্যায্যতার বোধের মধ্যে কোনওটি আছে। এই ক্ষেত্রেও সংশয় সেখানেই। দেশ মানে যে শুধু কলকারখানা বা বাজার নহে, মানুষ— দীনদরিদ্র মানুষ, প্রলম্বিত লকডাউন যাঁহাদের অতল খাদে ঠেলিয়া দিয়াছে— এই কথাটি সরকারি দর্শনে নাই। ফলে, তাঁহাদের হাতে টাকার ব্যবস্থা না হইলে অর্থব্যবস্থা বাঁচুক-মরুক, তাঁহারা যে বাঁচিবেন না, এই কথাটিও নির্মলা সীতারামনরা গত সাত-আট মাসে স্বীকার করিতে পারেন নাই।
অর্থশাস্ত্রীরা পরামর্শ দিতেছেন, এই পরিস্থিতিতে সব মানুষের ন্যূনতম আয় নিশ্চিত করুক সরকার। অতি উত্তম পরামর্শ। কিন্তু, সেই পরামর্শে সরকার কর্ণপাত করিবে, তেমন আশা ক্ষীণ। নূতন প্রকল্পের কথা ভাবিবার সাহস সরকারের যদি না-ও হয়, যে সকল প্রকল্প ইতিমধ্যেই আছে, সেগুলির পিছনেই সর্বশক্তিতে দাঁড়ানো প্রয়োজন। জাতীয় কর্মসংস্থান প্রকল্প এই দেশে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ নেটওয়ার্ক তৈরি করিয়া রাখিয়াছে— মানুষের হাতে টাকা পৌঁছাইয়া দিবার এমন সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা বিশ্বে বিরল। সরকার এই প্রকল্পকে যথোচিত গুরুত্ব দিক। শুধুমাত্র কথায় নহে, সেই গুরুত্বের প্রতিফলন ঘটুক কাজে। গ্রামাঞ্চলে তো বটেই, শহরেও কর্মসংস্থান যোজনায় যত বেশি সম্ভব মানুষকে নিয়োগ করা হউক। এবং প্রকল্পগুলি চাহিদা-চালিত হউক। অর্থাৎ, যত মানুষ কাজ চাহিবেন, তত জনেরই কর্মসংস্থান হইবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিকাঠামো নির্মাণ, স্বাস্থ্য অথবা অন্য যে খাতগুলিকে সরকার অগ্রাধিকার দিতেছে, সেখানেও কাজের চরিত্র শ্রমনিবিড় হউক।
মূল প্রশ্নটি গভীরতর— সমাজের মধ্যে যে সুগভীর ও ক্রমবর্ধমান আর্থিক অসাম্য, রাষ্ট্রের কি তাহা সহ্য করা উচিত? বর্তমান সরকার এই প্রশ্নের কী উত্তর দিবে, তাহা অনুমান করা চলে। স্পষ্ট ভাবে না বলিলেও এই সরকার ট্রিকল ডাউন বা চুয়াইয়া পড়া আর্থিক উন্নয়নে বিশ্বাসী। তাহার ফল মিলিতেছে— ভারতে আর্থিক অসাম্য ঐতিহাসিক শিখরে। এই অসাম্য ধনতন্ত্র বা বাজার ব্যবস্থার পক্ষে মঙ্গলকর নহে। অর্থনীতির পিরামিডের প্রতিটি ধাপেই যদি ক্রয়ক্ষমতা না থাকে, তবে চাহিদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়— বস্তুত, ভারতে অতিমারির প্রকোপ আরম্ভ হইবার পূর্বেই চাহিদা তলানিতে নামিয়াছিল। বাজারের স্বার্থেই অধিকতর মানুষের হাতে ক্রয়ক্ষমতা থাকা বিধেয়। কিন্তু, বাজারের এই স্বার্থটিই শেষ কথা নহে। আর্থিক অসাম্য যখন চড়া হয়, তখন দেশের মোট উৎপাদনের ন্যায্যতর বণ্টনের দায়িত্ব সরকার অস্বীকার করিতে পারে না। বিশেষত, এই বিপন্ন সময়ে। সবার জন্য প্রাথমিক আয়ের ব্যবস্থা করিবার প্রস্তাব এই দায়িত্বেরই প্রকাশ। মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব।