বাঁ দিকে, উদ্ধারকারী দম্পতি। ডান দিকে, উদ্ধার হওয়া তরুণী। —নিজস্ব চিত্র।
শহরের রাজপথে গভীর রাত্রে কোনও একাকী তরুণী বিপন্ন হইলে তাঁহাকে রক্ষা করিতে কী প্রয়োজন? নীলাঞ্জনা চট্টোপাধ্যায় বলিবেন, সাহসই যথেষ্ট। যে শহরে মুখ ফিরাইয়া চলিয়া যাওয়াই ক্রমে দস্তুর হইয়াছে, সেখানে নিজের প্রাণ বিপন্ন করিয়াও তরুণীর পার্শ্বে দাঁড়াইতে দ্বিধা করেন নাই নীলাঞ্জনা ও দীপ। সহনাগরিকের প্রতি সহমর্মিতার এই বিরল উদাহরণ আশ্বস্ত করে যে, এখনও আশা আছে, এখনও প্রাণ আছে। যে শহরে পথদুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির দিকে সাহায্যের একটি হাতও আগাইয়া আসে না, যেখানে মুমূর্ষু কোভিড রোগী অ্যাম্বুল্যান্সে উঠিবার জন্য এক জনেরও সাহায্য পান না, সেই শহরেই নীলাঞ্জনারাও থাকেন। প্রশ্ন হইল, সহমর্মিতাহীন নাগরিকপ্রবাহে নীলাঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়ের ন্যায় মানুষদের সংখ্যা কী ভাবে বাড়ানো যায়?
প্রয়োজন প্রশাসনের সক্রিয়তা। বিপন্নের পার্শ্বে দাঁড়াইবার সময় সহনাগরিকের মনে যাহাতে এই বিশ্বাসটি থাকে যে, প্রশাসন তাঁহার সহিত সর্ব প্রকার সহযোগিতা করিবে। বর্তমান ঘটনাটিতেও অভিযোগ উঠিয়াছে, পুলিশ যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে নাই। অপরাধীকে শনাক্ত করিতে, গ্রেফতার করিতে যতখানি সময় অতিবাহিত হইয়াছে, ক্ষেত্রবিশেষে তাহা অতি বিপজ্জনক হইতে পারে। তেমন অপরাধী হইলে এই সময়ে উদ্ধারকারীর প্রাণসংশয় হওয়াও বিচিত্র নহে। অপরের বিপদে ঝাঁপাইয়া পড়িবার পূর্বে নাগরিকের মনে এই ভরসা থাকিতে হইবে যে, ইহাতে তাঁহার বিপদ হইবে না, প্রশাসন তাঁহাকে রক্ষা করিবে। এই আস্থাটিই নাগরিক সক্রিয়তার পূর্বশর্ত। নীলাঞ্জনা বা দীপ ব্যতিক্রমী, তাঁহারা নিজেদের বিপদের কথা না ভাবিয়াই আগাইয়া আসিয়াছেন। কিন্তু, কোনও নাগরিক যদি ততখানি আত্মবোধহীন না হইতে পারেন, তাঁহাকে দোষ দেওয়া অনুচিত। বস্তুত, প্রশাসনের প্রতি আস্থার অভাব যে নাগরিক সক্রিয়তার পথে একটি মস্ত অন্তরায়, ভারতের আইনব্যবস্থা তাহা এক প্রকার মানিয়া লইয়াছে। ২০১৬ সালে একটি আদেশে সুপ্রিম কোর্ট জানাইয়াছিল, কেহ যদি পথদুর্ঘটনায় আহত কোনও অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে হাসপাতালে লইয়া আসেন, পুলিশ কোনও ভাবেই তাঁহাকে হেনস্থা করিতে পারিবে না। শুধু এই নেতিবাচক অধিকারটিই নহে, প্রশাসন যাহাতে সাহায্যকারী ব্যক্তির নিরাপত্তারক্ষায়, সাহায্যে, সর্ব প্রকারে সক্রিয় হয়, তাহা নিশ্চিত করাই একমাত্র পথ।
সেই রাত্রে যদি নীলাঞ্জনা অকুস্থলে না পৌঁছাইতেন, তবে কী হইত? সেই তরুণী কি রাস্তায় পড়িয়া থাকিতেন? আরও বড় কোনও বিপদ ঘটিত? এই প্রশ্নগুলি সমাজকে ভাবিত করিতেছে। নাগরিকের নিরাপত্তা তো কোনও সাহসী সহনাগরিকের সদিচ্ছার ভরসায় থাকিতে পারে না। রাস্তায় যথেষ্ট নজরদারি থাকুক, প্রহরা চলুক, সিসি ক্যামেরায় ধরা থাকুক প্রতিটি মুহূর্তের ঘটনাক্রম। রাষ্ট্রের নজরদারি যদি কোনও পরিসরে কাম্য হয়, তবে তাহা এই ক্ষেত্রে। এবং, কোনও ভাবেই যে চলন্ত গাড়িতে কাহাকেও হেনস্থা করা যায় না, করিলে কঠোর শাস্তি এড়াইবার উপায় নাই— এই কথাটি প্রতিষ্ঠা করিবার দায়ও পুলিশ-প্রশাসনেরই। ইহা ব্যক্তিগত প্রশ্ন নহে, শহরের আইনশৃঙ্খলার প্রশ্ন। বহু সভ্য দেশেই এহেন ঘটনার কথা কল্পনাও করা যায় না। পুলিশ-প্রশাসন এই বার সেই সভ্যতার সাধনা করিলে মঙ্গল।