আজ কিছু দিন ধরে একটি শিশুর কথা বার বার মনে পড়ছে। নিতান্ত উদ্বিগ্ন এক দম্পতি শিশু কোলে আমার শিশু-চিকিৎসক স্বামীর কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন। সমস্যা কী? টেলিভিশনের দিকে আঙুল তুলে শিশু ‘টিভিতে ভয়’, ‘টিভিতে ভয়’ বলে পরিত্রাহি চিৎকার করছে আর আতঙ্কে কাঁপছে। ডাক্তারের উপদেশ ছিল: ক’দিন টিভি বন্ধ, খেলনা, ছবি দেখিয়ে মন অন্য দিকে ফেরাতে হবে। সে কিন্তু কোনও ভয়াবহ দৃশ্য দেখেনি। খ্যাতনামা রবীন্দ্রসংগীত গায়িকা গান করছিলেন, ‘আমি রূপে তোমায় ভোলাবো না’। টিভির দোষে বা ঘরের আলোর বেকায়দায় এক মুহূর্তের জন্য গায়িকার চক্ষু বিস্ফারিত ও আলো ঠিকরে এসেছিল। সেই থেকে বিপত্তি।
বর্তমানে আমার মনের অবস্থা ওই শিশুটির মতো। টিভি খুলবার আগে বুক দুরুদুরু করে। খোলা মাত্রই পর্দায় বীভৎস সব দৃশ্য, হাড়গোড় নরকঙ্কাল। খবর ততোধিক ভয়াবহ, খুন, লুট, নারীর সম্ভ্রমহানি আর বিকারগ্রস্ত অপরাধীদের কথা, সন্তান পিতামাতাকে হত্যা করছে, মা কন্যাকে। আজ ঘরে ঘরে টেলিভিশন। আমাদের ছেলেমেয়েরা এই সব দেখতে দেখতে বড় হচ্ছে। কী যে হবে! চিন্তা হয়।
দোষ অবশ্যই টিভির নয়। চার পাশে যা ঘটছে, সামাজিক অবক্ষয়ের বাস্তব চিত্র সাংবাদিক তুলে ধরছেন, সেটাই তাঁর কর্তব্য। এ কথাও অনস্বীকার্য এই সব বিকৃতমনস্ক অপরাধ থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখলে বা কার্পেটের তলায় চাপা দিলে সমস্যার কোনও সমাধান হবে না। তবু বীভৎস দৃশ্য অথবা খুনির নির্বিকার মুখ দেখাবার সময়ে চ্যানেলগুলি নিজেদের বিবেচনা মতো একটু সংযম আরোপ করতেই পারেন। কায়রোতে মিউজিয়ামে মমির ঘরে সার দিয়ে সংরক্ষিত মৃতদেহ রাখা আছে। ঘরের দরজায় নোটিস লাগানো— ছোটদের আনা বাঞ্ছনীয় নয়, ভয় পেতে পারে। ছোটরা কেন, বড়দেরই গা ছমছম করে। বিদেশে দেখেছি টিভিতে ভয়াবহ দৃশ্য দেখাবার আগে লেখা ফুটে ওঠে— এখন আমরা ডিসটার্বিং ছবি দেখতে চলেছি। এ রকম সতর্কবাণী প্রচারের কথা এখানেও ভাবা যেতে পারে। যে রকম সর্বব্যাপী অবক্ষয়, তা তে লাভ কতটুকু হবে জানা নেই, তবু চেষ্টা করতে দোষ কী!
শুধু যে টিভি তা নয়, খবর কাগজেও তো একই ভয়াবহ, নেতিবাচক খবর প্রতিফলিত। সকালের কাগজে চোখ দেওয়ার আগেও দু’বার চিন্তা করতে হয়। প্রথম যখন পাতা জোড়া বিজ্ঞাপনে প্রথম পৃষ্ঠা আড়াল হল, তখন বিরক্ত বোধ করেছিলাম। ঘুম থেকে উঠেই প্রথম পৃষ্ঠায় চোখ পড়বে, বরাবরের অভ্যাস। এখন মনে হয় বিজ্ঞাপনে মুখ ঢাকা শাপে বর হয়েছে। প্রথমে লম্বা, অর্ধেক পাতা বিজ্ঞাপন, তার পর পুরো পাতা বিরাট ছবিওয়ালা আরও লোভনীয় বাণিজ্যিক প্রচার। প্রথম পৃষ্ঠায় পৌঁছবার আগে একটু সাহস সঞ্চয় করার সময় পাওয়া যায়।
এই সামাজিক ভয়াবহ অবক্ষয় নিয়ে বিশিষ্ট জনেরা মতামত দিচ্ছেন, আলোচনা চলছে। তার মধ্যে একটি কথা বার বার ফিরে আসছে— সোশ্যাল মিডিয়া। এই প্রজন্ম নাকি বাস্তব জগতে বসবাস করে না, তারা থাকে এক অলীক জগতে, যার নাম ‘ভার্চুয়াল’ জগৎ।
আজকের ছেলেমেয়েদের চার পাশে রক্ত-মাংসে গড়া আপনজন, বন্ধুবান্ধব নেই। তারা আছে ফেসবুক-এ। যেখানেই বন্ধুত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা, ভালবাসা, আশাভঙ্গ। মানসিক দিক থেকে স্বাস্থ্যকর নয়। অথচ প্রযুক্তি তো আমাদের অনেক ভাল কিছু দিয়েছে। বিশ্বকে এনে দিয়েছে নিজের ঘরে। সব ভাল জিনিসের মতো তারও আছে অন্ধকার দিক! নানাবিধ অপরাধের মতো এখন ‘সাইবার ক্রাইম’ও চিন্তার বিষয়। ‘অত বেশি চ্যাট করো না’— পিতামাতার এ হেন মন্তব্যে পুত্র-কন্যা বিদ্রোহ করে, আত্মঘাতী হয়, এমন খবরও দেখতে পাই। সব মিলিয়ে সমস্যা গভীর।
পৃথিবীতে হিংসা-দ্বেষ ছিল না এমন তো নয়, বরাবর ছিল। কিন্তু পাশাপাশি কোথাও ভাল-মন্দ, পাপ-পুণ্য বোধও কাজ করত। সেই লক্ষণরেখা অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমাদের দেশে শুধু নয়, সারা বিশ্বে নেমে এসেছে এক অভূতপূর্ব সামাজিক অবক্ষয়। হয়তো কোনও পরিত্রাতা দেখা দেবেন— যেমন বলা হয় ‘সম্ভবামি যুগে যুগে’। আমাদের সকলের কর্তব্য পৃথিবীকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলা।
এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন যে পৃথিবীতে কোথাও ভাল কিছু ঘটছে না। নিশ্চয় ঘটছে।
সকল রকম সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে সাধারণ বিবেক ও বোধসম্পন্ন মানুষ, সকলের কর্তব্য নেতিবাচক খবরের পাশে ইতিবাচক ঘটনাগুলি উজ্জ্বলতর করে প্রতিফলিত করা। ফল কত দূর হবে জানা নেই, কিন্তু কর্মে তো আমাদের অধিকার আছে।
ভূতপূর্ব (১৯৯৯-২০০৪) সদস্য, লোকসভা