Dooars

এ ভাবে চললে ক’দিন বাঁচবে ডুয়ার্স?

প্রকৃতি অকৃপণ ভাবে সাজিয়েছে উত্তরবঙ্গের পরিবেশকে। ডুয়ার্স যার বড় উদাহরণ। কিন্তু সেই ডুয়ার্য়েরই পরিবেশ চূড়ান্ত ভাবে কলুষিত হয়ে পড়েছে। হোটেল-রিসর্টের প্রাবল্য, নিয়ম না মানা উৎসবের আয়োজন, আবর্জনার স্তূপ, পিকনিক-পার্টির তাণ্ডব, মাত্রাছাড়া শব্দ— সব মিলিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে ডুয়ার্সের পরিবেশ। পরিবেশ কী ভাবে বাঁচাতে হয়, তা ভুটানের থেকে শেখা উচিত। লিখছেন সব্যসাচী ঘোষবাহারি রং-বেরঙের লেজার আলো। জঙ্গল চিরে আকাশে উঠে যাচ্ছে। ডিজের শব্দদানব নাকি নিষিদ্ধ বহু আগেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০১:৫৯
Share:

ডুয়ার্সের রাস্তায় প্লাস্টিকের দূষণ।

বাহারি রং-বেরঙের লেজার আলো। জঙ্গল চিরে আকাশে উঠে যাচ্ছে। ডিজের শব্দদানব নাকি নিষিদ্ধ বহু আগেই। জঙ্গলে ঘোড়া থাকলে ওরা নিশ্চয়ই পরম শ্লেষে বলত— ‘আর কয়েন না কত্তা! এরপর ঘোড়াও হাসব!’ হাজার লোকের মোচ্ছব! তাঁদের সামান্য এঁটো-কাঁটা, উচ্ছিষ্ট, যা কি না এক রাতেই দুর্গন্ধ ছড়িয়ে দিতে যথেষ্ট, তার ঠিকানা নদীর ধারে, জঙ্গলের কোলে বা পাহাড়ের খাঁজে।

Advertisement

এ ভাবেই বদলে যাচ্ছে ডুয়ার্স। আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে ভোগ বিলাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন শহুরে মানুষ। সেই যাবতীয় সুখ, সুবিধা দিয়েই ডুয়ার্সের নজরকাড়া পরিবেশে বসছে নানা অনুষ্ঠান। আর অতি আধুনিক এই সব উৎসব, অনুষ্ঠানের ঠেলাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হচ্ছে শুধু পরিবেশের। কী হয় সেই সব অনুষ্ঠানে? ডিজে সহযোগে নাচ হয়, পার্টি হয়, সুইমিং পুল পার্টি হয়, বিয়ের আসর বসে, খোলা আকাশে জঙ্গলের নির্জনতা দেখতে দেখতে ভিয়েন সাজিয়ে খানাপিনা হয়। হয় আরও কত কিছু!

শুধু এই পর্যন্ত হলেও না হয় ঠিক ছিল। কারণ, মালিকেরা তো নিয়ম মেনেই রিসর্ট-হোটেল চালান বলেই দাবি করেন। পারদ বিপদসীমা অতিক্রম করে যখন পার্টি বা উৎসব চলে। কিনতু ৩৬৫ দিনই কি এ সব চলেশ না, চরম নিন্দকও সে কথা বলবেন না। কিন্তু এখন ডুয়ার্সেই শুধু হোটেল বা রিসর্ট নির্মাণ হচ্ছে, এমন নয়। উপনগরী গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যেই চালসা ছাড়িয়ে লাটাগুড়ির পথে বাতাবাড়ি এলাকায় বিরাট উপনগরী গড়ে উঠছে। বিজ্ঞাপনে ক্রেতা খোঁজার কাজও জোরদার গতিতে এগোচ্ছে। আপনি কি চা-বাগানে বসে কখনও চা পান করেছেন? জঙ্গলের পরিবেশে আপনার একটা নিজস্ব বাড়ি হবে, ভেবেছেন কখনও? এমন সব কথা সাজিয়ে, পরিবেশকে মূলধন করে ফ্ল্যাটবাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপনের বয়ান তৈরি হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, তা হলে ডুয়ার্সের নিজস্বতা বলে কি আর সত্যিই কিছু থাকবে না? না কি শান্তিনিকেতনের কোপাই নদীর নির্জনতা ভঙ্গ করে যে ভাবে একের পর এক গ্রাম ধীরে ধীরে অতি-শহরে বদলে গিয়েছে, তেমন দশাই হবে ডুয়ার্সের? এই উদ্বেগই এখন গ্রাস করছে নানা মহলকে।

Advertisement

ডুয়ার্সে বিলাস-ব্যসনে ভরপুর রিসর্ট এখন অজস্র। সেখানে প্রমোদের আয়োজন অহরহ ঘটে। গরুমারা জঙ্গল লাগোয়া মূর্তি নদীর পাড়ে সেই রিসর্টে বড় মাপের বলিউড তারকাদের অনুষ্ঠানও হয়ে থাকে। খোলা লনের এই সব বিরাট অনুষ্ঠানে নৃত্য যতটা উপস্থিত অতিথিদের মন ভরিয়ে তোলে, তার চেয়েও সেখান থেকে উৎপন্ন শব্দ ধ্বংস করে জঙ্গলের স্বাভাবিকতা। এ নিয়ে সরব পরিবেশপ্রেমীরা। একই ভাবে মূর্তি এলাকাতে একাধিক রিসর্ট একই ট্র্যাডিশন মেনে ফি-মাসে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করে চলেছেন। মাত্র মাসখানেক আগের কথা। মূর্তিপাড়ের এমনই এক বাহারি আলোর অনুষ্ঠানের ছবি-সহ অভিযোগ গিয়েছিল রাজ্যের পর্যটন মন্ত্রী গৌতম দেবের কাছে। মন্ত্রী অভিযোগ পেয়েই দ্রুত সক্রিয় হন। নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেন। তারপর মূর্তি নদীর ধারে কিছুটা নীরবতা ফিরলেও সর্বত্র কিন্তু তা হয়নি। গত জানুয়ারিতেই যেমন গজলডোবার পর্যটন হাবে সদ্য তৈরি হওয়া এক বিলাসবহুল হোটেলে সন্ধ্যা থেকে আমোদ প্রমোদের অনুষ্ঠান বসে। শীতকালে গজলডোবা জুড়ে এখন পরিযায়ী পাখিদের ভিড়। তীব্র লেজার আলো, প্রকাণ্ড জিজে বক্সের আওয়াজ এই অতিথি পাখিদের যে মোটেই ভাল লাগে না, তা বলাই বাহুল্য। ঠিক সেই সময়েই গজলডোবার ওই প্রকল্প লাগোয়া ক্যানাল সড়কের উল্টো প্রান্তের এক বেসরকারি রেস্তরাঁয় খাবার খেতে ঢুকেছিলেন পর্যটন মন্ত্রী। তিনি নিজেই সেখানে বসে পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। এরপর সেই হোটেল মালিককে সতর্কও করেন মন্ত্রী। কোনও অবস্থাতেই প্রকৃতির ক্ষতি করে কোনও আমোদ-প্রমোদ আয়োজন বরদাস্ত করা হবে না বলেও সাফ জানান গৌতম দেব।

উত্তরবঙ্গের পর্যটনকেন্দ্রগুলির বেশির ভাগই জঙ্গলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা। সংরক্ষিত এবং জাতীয় উদ্যানকে ঘিরে অবস্থান করছে এমন রিসর্টের সংখ্যা লাটাগুড়ি, বক্সা, চিলাপাতা, জলদাপাড়া, মাদারিহাট এলাকায় কম নয়। তাই বন দফতরের অনুমোদনও জরুরি। এখানেও রয়েছে অভিযোগ। বনের নিয়ম না মেনেই বেসরকারি লগ্নি নিয়মিত হয়ে চলেছে। অভিযোগ, জঙ্গল কেটে প্রথমে যেখানে চাষের জমি বানানো হয়েছিল, বন দফতরের উদাসীনতায় সেই জমিই পরবর্তী সময়ে চড়া দামে হোটেল মালিকেরা কিনে নিয়েছেন। বন দফতরের বিরুদ্ধে যেমন উদাসীনতার অভিযোগ রয়েছে, তেমনই পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধেও নীরবতার অভিযোগ তুলছেন পরিবেশপ্রেমীরা। পর্যটনপ্রধান জেলাগুলিতে জেলাশাসককে মাথায় রেখে পৃথক পর্যটন উন্নয়ন কমিটি কিছু বছর আগে গঠন করা হলেও কোন জেলায় কী ভাবে পর্যটনের জন্যে হোটেল, রিসর্ট নির্মাণ করতে হবে, তার এখনও অবধি কোন রূপরেখা তৈরি হয়নি। ফলে, যে যেমন পারছেন, বড় বড় কংক্রিটের নির্মাণ সগড়ে তুলছেন। নির্মাণবিধি অবিলম্বে পর্যটন ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হওয়া জরুরি বলে তাই দাবি উঠেছে।

এ সবের পাশাপাশি দ্রুত জঞ্জাল অপসারণ নিয়েও ভাবতে হবে। ডুয়ার্সের গ্রামীণ জনজীবনে ডাম্পিং গ্রাউন্ড শব্দটি নেই। কারণ, ডুয়ার্সের একাধিক পুরএলাকা এই ডাম্পিং সমস্যায় প্রতিনিয়ত জর্জরিত। নেই নিকাশি ব্যবস্থাও। হোটেল, রিসর্টের শৌচাগারের আবর্জনাও ফেলে দেওয়া হয় জঙ্গলের যেখানে-সেখানে। দূষণ ছড়ানোর পাশাপাশি মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কাও থেকে যায় বন্যপ্রাণের। হাতির মলে প্লাস্টিক এখন প্রায় আকছার মিলছে, যাকে শেষ দু’দশকে ডুয়ার্সে পর্যটন শিল্পের প্রবল উত্থানের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বলেই মনে করছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞেরা।

ডুয়ার্সের চেয়েও বহুগুণে দুর্গম, প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামসমৃদ্ধ পর্যটননির্ভর দেশ ভুটান। ডুয়ার্স পেরিয়েই সেই দেশে যেতে হয়। যাঁরা ডুয়ার্স ও ভুটান দু’জায়গাতেই গিয়েছেন, তাঁরা বিশেষজ্ঞ না হয়েও সেই দেশের জঞ্জাল অপসারণ বা দূষণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্পষ্ট তফাৎ দেখতে পান। ভুটানে পরিবেশ রক্ষা বিষয়ে জনমত সংগঠিত।জঙ্গল সেখানে স্বাভাবিক প্রকৃতিকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। আর জরুরি প্রশ্নটি এখানেই! ভারতের চেয়ে নানা দিক থেকে পিছিয়ে থাকা দেশ ভুটানও যা পারছে, আমরা তা পারছি না কেন?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement